হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ সরকারি কলেজের (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যক্ষ মো. সফর আলীসহ ১৮জনের বিরুদ্ধে অর্থ কেলেঙ্কারীসহ নানা অনিয়মের সত্যতা পেয়ে তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে।
শনিবার (১১ সেপ্টেম্বর) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মহিউদ্দিন।
জানা যায়, (গত ১৫ জুলাই) নবীগঞ্জ সরকারি কলেজের প্রভাষকবৃন্দ যথাক্রমে মোজাম্মেল আলী শিকদার, মো, শাহিন মিয়া, মাসুদ মিয়া, ফরিদ আহমদ, মোদাচ্ছির আলী, মইনুল ইসলাম জাকির, সুব্রত কুমার সাহা, আবুল কাশেম, ফাতেমা তুজ জহুরা, সালমা জাহান চৌধুরী, খালেদা বেগম ও মহিমা আক্তারসহ ১২জন শিক্ষকের যৌথ স্বাক্ষরে নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবর নবীগঞ্জ সরকারি কলেজের আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়কৃত বেতন সঠিকভাবে শিওর ক্যাশের মাধ্যমে পোস্টিং না দেয়া, বিগত কয়েক বছর যাবত বেতন আদায়ের ক্ষেত্রে বেতন রেজিস্টার বহি রক্ষণাবেক্ষন করা হয়নি। এছাড়াও বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানানো হয়।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে নবীগঞ্জ উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) উত্তম কুমার দাশকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন, নবীগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাদেক হোসেন, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নুসরাত ফেরদৌসি। এরপর শুরু হয় তদন্ত । দীর্ঘ তদন্ত শেষে নবীগঞ্জ সরকারি কলেজের অনিয়ম দুর্নীতির তদন্ত সম্পন্ন করা হয়। ৩১ আগস্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কমিটি।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর নবীগঞ্জ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মো. সফর আলী। এছাড়া বিগত চার বছর পূর্বে অবৈধভাবে নয়ন মনি সরকার নামে এক যুবককে কলেজের কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগ করা হয়। নয়ন মনি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়, বেতন ফি টাকা গ্রহণ করে শিওর ক্যাশের মাধ্যমে পোস্টিং দেয়। শিক্ষার্থীরা বেতন দেয়ার পর তাদেরকে একটি স্লিপও দেয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অনার্স ২য় বর্ষের প্রতি বছর সেশন ফি ১০০০ হাজার টাকা, বেতন ৬ হাজার টাকা, পরীক্ষা ফি ৮শ টাকা। এসব টাকা শিওর ক্যাশের মাধ্যমে পেমেন্ট করতে হয়। শিওরক্যাশে টাকা পোস্টিং হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের মোবাইল নাম্বারে ম্যাসেজ যাওয়ার নিয়ম থাকলেও শিক্ষার্থীরা কোনো বার্তা পাননা। শিক্ষার্থীদের নাম্বারে স্থানে অধিকাংশ সময় কম্পিউটার নয়ন মনির নাম্বার ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে কত টাকা শিওর ক্যাশের মাধ্যমে পোস্টিং দেয়া হচ্ছে সেই তথ্য অজানা রয়ে যায় শিক্ষার্থীদের কাছে।
অনার্স ২য় বর্ষের সমাজ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোছাঃ রিমা বেগম ২০২১ সালের প্রায় ৫ মাসের বেতন মওকুফ করায় কলেজ কর্তৃপক্ষের উপর খুশি তিনি। কম্পিউটার নয়ন মনির কাছে বেতন ও সেশন ফিসহ জমা দেন ৪৪০০ টাকা। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, শিওর ক্যাশে টাকা পোস্টিং দেয়া হয়েছে ২৩০০ টাকা।
একইভাবে ফারহানা বেগম বেতন ও সেশন ফির ৫৪০০ টাকা দেন কিন্তু শিওর ক্যাশে টাকা পোস্টিং দেয়া হয় ২৩শ টাকা, রিফা আক্তার ৪৯০০ টাকা দিলেও শিওর ক্যাশে টাকা পোস্টিং দেয়া হয় ২৩শ টাকা, হেনা আক্তার ৪৯০০ টাকা দেন কিন্তু শিওর ক্যাশে টাকা পোস্টিং দেয়া হয় ২৩শ টাকা। শিওর ক্যাশে টাকা জমার বিষয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কম্পিউটার নয়ন মনি অতিরিক্ত আরও ১শ টাকা আদায় করতো। এমন কর্মকাণ্ডে হতভম্ব শিক্ষার্থীরা।
তদন্তের শুনানী চলাকালে অনার্স ২য় বর্ষের ৩২জন শিক্ষার্থীদের মওকুফের আবেদন, অনলাইন বেতনশীট পর্যালোচনা করে তদন্ত কমিটি। পর্যালোচনায় দেখা যায়, শুধুমাত্র ওই ৩২ জন শিক্ষার্থীর শুধুমাত্র বেতনের ৬৩ হাজার ৭শ টাকা সার্ভারে এন্টি না করে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কাম হিসাব সহকারী জ্যোতিষ রঞ্জন সরকার, নিম্নমান সহকারী বিন্দু ভূষণ বৈদ্য, খন্ডকালীন কম্পিউটার অপারেটর নয়ন মনি সরকার কলেজ কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে আত্মসাৎ করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, যেহেতু একটি শ্রেণীর একটি শিক্ষা বর্ষের ৩২জন শিক্ষার্থীর ৬৩ হাজার ৭শ টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটে সে হিসেবে অনার্স ১ম, ৩য় বর্ষ, ডিগ্রী (পাস) ১ম, ২য়, ৩য় বর্ষ এবং উচ্চ মাধ্যমিক ১ম ও ২য় বছরে গড়ে ৩২জন শিক্ষার্থীদের (১ বছরে) ৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা দুর্নীতি হয়েছে। যদিও নবীগঞ্জ সরকারি কলেজে অনার্স ১ম,২য়,৩য় বর্ষ, ডিগ্রী (পাস) ১ম, ২য়, ৩য় বর্ষ এবং উচ্চ মাধ্যমিক ১ম ও ২য় বর্ষে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৮ সালের ২৭ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ বেসরকারি কলেজ-৬ শাখা কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপন যার স্বারক নং- ৩৭.০০.০০০০,০৭০.০০২.০০৪.২০১৮-৮৮ অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের বেতন মওকুফসহ সকল আর্থিক বিষয়াদিসহ অন্যান্য কার্যক্রমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও অধ্যক্ষ’র যৌথ স্বাক্ষর ও অনুমোদন দেয়ার কথা থাকলেও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সফর আলী স্বাক্ষরিত কলেজে গঠিত বিভিন্ন কমিটি একচ্ছত্রভাবে নিয়ম বর্হিভূতভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমোদন ব্যতিত শিক্ষার্থীদের বেতন মওকুফ করেছেন। এর ফলে বেতন ফি যথাযথভাবে সার্ভারে এন্টির ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে। এছাড়া বেতন রেজিস্টার বই,ক্যাশবই রক্ষণাবেক্ষন করা হয়নি।
তদন্তে (১) নবীগঞ্জ সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. সফর আলীর বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা, অর্থিক অনিয়ম প্রশাসনিক অনিয়ম, অর্থ-আত্মসাৎ-দুর্নীতি প্রমান পাওয়া যায়। (২) কলেজের কর্মরত কর্মচারী কাম হিসাব সহকারী সুনাম উদ্দিন, ল্যাব সহকার জ্যোতিষ রঞ্জন সরকার, নিম্নমান সহকারী বিন্দু ভূষণ বৈদ্য, খন্ডকালীন কম্পিউটার অপারেটর নয়ন মনি সরকারের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা, অর্থিক অনিয়ম, প্রশাসনিক অনিয়ম, অর্থ-আত্মসাৎ ও দুর্নীতির প্রমান পাওয়া যায়। (৩) নবীগঞ্জ সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. সফর আলীর স্বাক্ষরিত অডিট কমিটির আহবায়ক ফজলে এলাহী মো. ফরহাদ, সদস্য মো. মিছবাহ উদ্দিন, শাহ ফুয়াদ ইমাম, মোজাম্মেল আলী শিকদার, শাহিন মিয়া, দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা, প্রশাসনিক অনিয়মের প্রমান পাওয়া যায়। (৪) বেতন মওকুফ কমিটি (অর্নাস) আহবায়ক শাহ ফুয়াদ ইমাম, সদস্য মোজাম্মেল আলী শিকদার, শাহিন মিয়া, আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা, প্রশাসনিক অনিয়মের প্রমান পাওয়া যায়। (৫) বেতন মওকুফ কমিটি (ডিগ্রী) আহবায়ক হাবিবুর রহমান, সদস্য অসীম কুমার রায়, ফজলে এলাহী মো. ফরহাদ, মো. মোদাচ্ছির আলীর বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা, প্রশাসনিক অনিয়মের প্রমান পাওয়া যায়। (৬) বেতন মওকুফ কমিটি (দরিদ্র-মেধাবী ও করোনাকালীন) আহবায়ক কৃপেশ চন্দ্র দেব, সদস্য রেজাউল আলম, রুপেশ চন্দ্র দাশ, শাহীন মিয়া, দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা, আর্থিক অনিয়ম, প্রশাসনিক অনিয়মের প্রমান পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে নবীগঞ্জ সরকারি কলেজের (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যক্ষ মো. সফর আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে সব মিথ্যা ও ষড়যন্ত্র।
এ প্রসঙ্গে নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মহি উদ্দিন বলেন, শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ কর্তৃক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের বেতন মওকুফসহ সকল আর্থিক বিষয়াদিসহ অন্যান্য কার্যক্রমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও অধ্যক্ষ’র যৌথ স্বাক্ষর ও অনুমোদন দেয়ার নিদের্শনা থাকলেও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সফর আলী নিজের মত করে তাঁর একক স্বাক্ষরে কলেজে বিভিন্ন কমিটি গঠন করেছেন, শিক্ষার্থীদের বেতন মওকুফ করেছেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ একচ্ছত্রভাবে নিয়ম বর্হিভূতভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমোদন ব্যতিত উনার মনগড়া কার্যক্রম পরিচালানা করেছেন এর ফলে অনিয়ম দুর্নীতি সংগঠিত হয়েছে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা মাধ্যমিক অধিদপ্তরের কাছে বিভিন্নভাবে দুর্নীতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, নবীগঞ্জ কলেজে অধ্যক্ষ পদায়ন ও কলেজের আর্থিক বিষয়ে জরুরী ভিত্তিতে সরকারি অডিটের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ প্রেরণ করা হয়েছে।