দিনারপুরে পাহাড়-টিলা কেটে ‘জিরো থেকে হিরো’ টু ব্রাদার বাহিনী

জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ জুলাই ২০২২, ৮:১০ অপরাহ্ণ
হবিগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি পরগনা খ্যাত নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুর অঞ্চল। ৩টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত পাহাড়ি পরগনার ঐতিহ্য দিন-দিন হচ্ছে বিলীন। পাহাড় খেকোদের অত্যাচারে অনিরাপদ হয়ে উঠছে পাহাড়ি জনপদ। নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ দেখা দিচ্ছে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
সাম্প্রতিক সময়ে টু-ব্রাদার নামক বাহিনী কর্তৃক একেরপর এক কর্তন করা হচ্ছে পাহাড়-টিলা। ফলে শত-শত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের কার্যকরী উদ্যোগ না নেওয়ায় দিন-দিন পাহাড় কেটে মাটি বিভিন্নস্থানে বিক্রি করে ‘জিরো থেকে হিরো’ হয়ে উঠেছে এই ‘টু ব্রাদার’ বাহিনী।
জানা যায়- ২০১৫ সালের ২২ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ‘হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে পাহাড় কাটা থামছে না’ শীর্ষক শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন সংযুক্ত করে পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ পক্ষে ওই বছরের (১৩ ডিসেম্বর) হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়।
(১৪ ডিসেম্বর) হাইকোর্ট পাহাড় কাটার ওপর স্থিতাবস্থা জারি করে রুল জারি করেন। রুল শুনানি শেষে চূড়ান্ত রায়ে- নবীগঞ্জের দিনারপুরে পাহাড় ও টিলা কাটা রোধে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
এছাড়া হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারকে পাহাড় ও টিলা সংরক্ষণে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়।
উচ্চ আদালতের এমন নির্দেশনা থাকার পরও থেমে নেই পাহাড় কাটা। কখনো দিনে কিংবা রাতের আধাঁরে অতি সুকৌশলে পাহাড় কেটে উজার করে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন চক্র। ২০১৬ সালের (১ নভেম্বর) পাহাড়ি অঞ্চল দিনারপুর এলাকায় পাহাড় কাটতে গিয়ে পাহাড় ধ্বসে দুই শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে ধারাবাহিক ভাবে বছরের অধিকাংশ সময় দিনারপুর পরগণার পানিউমদা, গজনাইপুর ও দেবপাড়া ইউনিয়নে পাহাড় ও টিলা কাটা চলছে। ২০১৭ সালে আবির্ভাব ঘটে পাহাড় কাটা চক্রের মধ্যে অন্যতম বাহিনী ‘টু-ব্রাদার’। এই চক্রের সদস্য সংখ্যা প্রায় অর্ধশতাধিক।
দেবপাড়া ইউনিয়নের মাঠ বনগাঁও গ্রামের ওয়াহাব মিয়ার দুই ছেলে সিরুল মিয়া ওরফে ল্যাংড়া সিরুল ও সেলিম মিয়ার নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয়েছে টু ব্রাদার বাহিনী। এই দুইভাই পাহাড় ও টিলা কেটে মাটি বিক্রি করে এখন ‘জিরো থেকে হিরো’। অর্জন করেছেন লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি। সাম্প্রতিক সময়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এই টু ব্রাদার বাহিনী।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়- চলতি বছরের মে মাসে নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের নলসুজা ফুটবল মাঠের পাশে সরকারি খাল কেটে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে সদরঘাট নতুন বাজারে অবস্থিত আব্দুস শহীদের মালিকানাধীন কোটি টাকার জায়গা ভরাট করে দেয় এই ‘টু ব্রাদার বাহিনী’। স্থানীয়রা একাধিকবার প্রশাসনকে অবগত করলেও অদৃশ্য কারণে ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।
এরপর বাশডর এলাকায় ফসলি জমি কাটতে গিয়ে প্রশাসনের অভিযানে টু ব্রাদার বাহিনীর এক্সেভেটর মেশিন জব্দ করে চাবি নিয়ে যায় প্রশাসন। উপজেলা প্রশাসন ঘটনাস্থল ত্যাগের পর পর বিকল্প চাবি দিয়ে এক্সেভেটর মেশিন সরিয়ে নিয়ে যায় এই অসাধু চক্র। তবে এ ঘটনার পরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে প্রশাসনের নিরবতা লক্ষ্য করা যায়।
জুন-জুলাই মাসে দেবপাড়া ইউনিয়নের দেবপাড়া কোনাপাড়া এলাকার তফিক মিয়ার মালিকানাধীন বিশাল টিলা কেটে বিভিন্নস্থানে মাটি বিক্রি করে সিরুল-সেলিমের নেতৃত্বাধীন ‘টু ব্রাদার বাহিনী’ ৷ টিলা কেটে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে বিলাশ বহুল বিল্ডিং।
সবশেষ গত শনিবার (৯ জুলাই) ভোর থেকে গজনাইপুর ইউনিয়নের শংকরসেনা গ্রামের মৃত হেকিম মিয়ার ছেলে আফজল মিয়ার মালিকানাধীন পাহাড় কাটা শুরু করে টু ব্রাদার বাহিনী। ওইদিন বিকেলে নবীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) উত্তম কুমার দাশ অভিযান চালিয়ে পাহাড় কাটায় জড়িত মাটি বুঝাই একটি ট্রাক্টর ও চালককে আটক করেন। পরবর্তীতে বিকল্প চাবি দিয়ে মাটি বুঝাই ট্রাক্টর সরিয়ে নিয়ে যায় টু ব্রাদার বাহিনী। ওইদিন রাতে প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়ায় আটককৃত ট্রাক্টর চালক ইমনকে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেয় প্রশাসন । ‘টু ব্রাদার বাহিনী’র ক্ষমতা ও প্রভাবের কাছে তটস্থ প্রশাসন অদৃশ্য কারণে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় জনমনে ওঠছে নানা প্রশ্ন। সমালোচনার মুখে প্রশাসনের ভূমিকা।
এদিকে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সঠিক ভাবে প্রয়োগ না করায় এবং প্রশাসনের সমন্বয়হীনতার কারণে সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে পাহাড়-টিলা কাটা ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করেন সচেতনমহল এবং পরিবেশবিদরা।
এ নিয়ে নবীগঞ্জ উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি তনুজ রায় বলেন- হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে পাহাড় কাটার ফলে আমাদের বিভিন্ন প্রাকৃতিক সংকট দেখা দিচ্ছে, প্রশাসনের সমন্বয়হীনতার কারণে সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে এইরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে এবং সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
হবিগঞ্জ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন- জেলার প্রাকৃতিক অঞ্চলের মধ্যে নবীগঞ্জ অন্যতম। সাম্প্রতিক সময়ে বন্যা ও খড় তাপ যে আমরা উপলব্ধি করছি তার সাথে পরিবেশের বনভূমি,নদী, নালা, খাল, ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এসব পাহাড়,টিলা,বন,নদ,নদী,খাল ধ্বংস করার জন্য এক শ্রেণীর মানুষ ওঠে পড়ে লেগেছে। তিনি বলেন- ক্ষমতা যেখানে আছে সেখানেই পরিবেশের ক্ষতি হয় পরিবেশ ধ্বংস হয়। যেভাবে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংস করা হচ্ছে ভবিষ্যতে তা মারাত্মক আকার ধারণ করবে। বাপা সম্পাদক আরও বলেন, পাহাড় টিলা সংরক্ষণের জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও পাহাড়-টিলা কাটা অব্যাহত রয়েছে এ বিষয়টি দুঃখজনক। পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশে এতো কঠোর কঠোর আইন আছে যা বিশ্বের অনেক দেশেই নেই কিন্তু সেইসব আইন অমান্য করেই বনভূমি,পাহাড়-টিলা কাটা হচ্ছে এতে করে পরিবেশ-প্রতিবেশ জীববৈচিত্র্যের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতার কারণে এবং এসব বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ না করা করার ফলে পাহাড় ও টিলা ধ্বংস হচ্ছে। তিনি পাহাড়-টিলা ও পরিবেশ ধ্বংসে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করে তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য জোরদাবী জানান।
নবীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) উত্তম কুমার দাশ বলেন- পাহাড় কাটার ঘটনায় আমরা মামলাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে চিঠি লিখবো। অবশ্যই জড়িতদের ছাড় দেয়া হবেনা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মহিউদ্দিন বলেন- পাহাড়-টিলা কাটার ব্যাপারে সঠিক সময় আমরা তথ্য না পাওয়ায় কারণে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছেনা, পাহাড়-টিলা কাটায় জড়িতদের ধরতে প্রশাসন জনপ্রতিনিধিসহ সকলের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। সকলের প্রচেষ্টায় প্রকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে সিলেট বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন- পাহাড়-টিলা কাটার বিষয়ে আমাদের অফিস থেকে একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবে এবং পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান বলেন- যখনই পাহাড়-টিলা কাটার খবর পাচ্ছি আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছি, নবীগঞ্জে পাহাড় কাটার ব্যাপারে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

