অর্থনৈতিক সম্পর্কে বাংলাদেশের সাথে এগিয়ে চীন না ভারত ?
জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জুন ২০২০, ১১:০৮ পূর্বাহ্ণচীন ও ভারতের মধ্যকার চলমান সংকট শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে রূপ নিলে বাংলাদেশকে নীরব দর্শক হয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, প্রতিবেশী ভারত এবং চীন দুই দেশই বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শুধু তারাই অবদান রাখছে এমনটি নয়, বাংলাদেশও এই দুই দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে রফতানি করে ও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে চীন ও ভারত উভয়ই লাভবান হচ্ছে। তবে পর্যবেক্ষক মহলের প্রশ্ন, বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কে কে বেশি এগিয়ে চীন না ভারত? কিংবা এই দুটি দেশের মধ্যে আবদানই বা কার বেশি?
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, রফতানির ক্ষেত্রে ভারত ও চীন আমাদের কাছে প্রায় সমান গুরুত্ব বহন করে। অর্থাৎ দুটি দেশই এক বিলিয়ন ডলারের কম পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ। আর আমদানির ক্ষেত্রে চীনের ওপরে আমাদের নির্ভরশীলতা বেশি হলেও প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্য আমরা খুব সহজেই আমদানি করতে পারছি। তিনি মনে করেন, ভারত খাদ্য পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে খুবই ভালো প্রতিবেশী। তবে অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিশেষ করে শিল্পায়নের জন্য বাংলাদেশকে চীনের ওপরই বেশি নির্ভরশীল হতে হয়। এছাড়া সরাসরি বিনিয়োগের (এফডিআই) ক্ষেত্রেও ভারতের চেয়ে চীন এগিয়ে আছে বলে তিনি মনে করেন।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখনও পর্যন্ত চীনের অবদান বেশি। তবে ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ লেগে গেলে দুই দেশই বাংলাদেশকে কাছে পাওয়ার চেষ্টা করবে। সে জন্য দুদেশ থেকেই বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব ও চাপ আসতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনও পক্ষেই যাওয়া উচিত হবে না। বরং এক্ষেত্রে নীরব দর্শক হয়ে থাকাই মঙ্গলজনক হবে।’
চীন ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য কেমন, তা জানা যায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যেও।
পণ্য আমদানি:
পরিসংখ্যান বলছে, ভারত থেকে ২০১৯ সালে ৭ হাজার ৬৪৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই একই বছরে চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে ১৩ হাজার ৬৩৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ ভারতের চেয়ে চীন থেকে প্রায় দ্বিগুণ পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ।
পণ্য রফতানি
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ২০১৯ সালে ভারতে পণ্য রফতানি হয়েছে ৯৩০ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের। আর চীনে পণ্য রফতানি হয়েছে ৭৪৭ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারের।
দুই দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে ৬ হাজার ৭১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে ১২ হাজার ৮৯১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিনিয়োগ
এখনও পর্যন্ত চীন থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ এসেছে (স্টক বিনিয়োগ) ২ হাজার ৯০৭ মিলিয়ন ডলার। আর ভারত থেকে আসা স্টক বিনিয়োগের পরিমাণ মাত্র ৬০২ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ভারতের চেয়ে চীন প্রায় পাঁচ গুণ বেশি বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশে।
নতুন বিনিয়োগ
২০১৯ সালে চীন থেকে বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগ এসেছে এক হাজার ৪০৮ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১৯ সালে ভারত থেকে নতুন বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ১৫০ মিলিয়ন ডলার। নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও চীনের ধারে-কাছেও নেই ভারত।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীন ও ভারতের অবদান যেমনটি আছে, তেমনই বাংলাদেশও প্রতিবেশী এই দুই দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। দেশ দুটি বাংলাদেশে রফতানি করে ও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশও প্রতিবেশী দুই দেশকে সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে এই দুই দেশের বিনিয়োগ যাতে বাড়ে, সে জন্য আলাদা আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। যেমন, চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য আনোয়ারাতে এবং ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য তিনটি অঞ্চল— মোংলা, পাকশি এবং মিরেরসরাইতে স্পেশাল অর্থনৈতিক জোন করে দেওয়া হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, এরই মধ্যে দু-দেশের সঙ্গেই আমাদের বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বাড়ছে। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘একদিকে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বেড়েছে। অন্যদিকে ভারতে আমাদের রফতানি বেড়েছে।’
প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই থেকে মে) বাংলাদেশ থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে ভারতে রফতানি হয়েছে ১০৫ কোটি ৬২ লাখ ডলার। আর চীনে রফতানি হয়েছে ৫৫ কোটি ৭১ লাখ ডলার।
ভোগ্য পণ্যের নির্ভরশীলতা বিপদের কারণ
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরের মতে, ভারতের ভোগ্য পণ্যের ওপরে বাংলাদেশের বড় নির্ভরশীলতা বিপদের কারণও। তিনি বলেন, ‘ভারত সম্প্রতি পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেওয়ায় ২০ টাকা দামের কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম গিয়ে দাঁড়ায় ২২০ থেকে ২৫০ টাকায়।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানি করা পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে— তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য ও প্রকৌশল পণ্য। আর ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি হয়— বস্ত্র খাতের সুতা, ভোগ্য পণ্য, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের অবদান কতটুকু, তা বলা না গেলেও বাংলাদেশ প্রতিবছর সারাবিশ্ব থেকে যে পরিমাণ আমদানি করে, তার ৩৫ শতাংশই করে চীন থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় সুতা এবং গার্মেন্টের কাপড়। এরপর বিপুল পরিমাণে নানা ধরনের ইলেকট্রনিক্স পণ্য ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি হয়ে থাকে। তবে চীনের চেয়ে ভারতে পণ্য রফতানি বেশি করছে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে চীনের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য যাতে সহজে প্রবেশ করতে পারে বা চীনে বাংলাদেশের রফতানি বাড়ে, সে জন্য চীন সম্প্রতি বাংলাদেশকে বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে চীনের বাজারে আরও ৫ হাজার ১৬১ পণ্যের ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে বাংলাদেশ এ সুবিধা পাবে। আর এটি বলবৎ থাকবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। অবশ্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চীন থেকে এপিটির আওতায় ৩ হাজার ৯৫টি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছিল। ওই সুবিধার বাইরে ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হলো। এতে শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় চীনের বাজারে বাংলাদেশের ৮ হাজার ২৫৬টি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় এলো।
গবেষক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘চীনের প্রচুর নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করছেন। একইভাবে ভারতের নাগরিকরাও বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। চীনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভারতীয় বাংলাদেশে কাজ করছেন।’
চীনা নাগরিকরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করছেন। আর ভারতের নাগরিকদের অধিকাংশই বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করছেন। ফলে বাংলাদেশ থেকে দুই দেশই বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্সও নিয়ে যাচ্ছে। কালো বাজারির মাধ্যমেও ভারতীয় পণ্য এদেশে প্রবেশ করছে। টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন চলছে। এর বাইরে চিকিৎসা ও কেনাকাটার জন্যও অনেকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে যাচ্ছেন বলেও তিনি জানান।
তিনি বলেন, ‘চীনের পরেই ভারত থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে। দেশটি থেকে বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের বড় অংশই হলো শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্য। এছাড়া বিপুল পরিমাণ খাদ্যপণ্য আমদানি হয় ভারত থেকে।’
জানা গেছে, কয়েক বছর আগেও ভারত থেকেই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করতো। তবে এখন ভারতকে পেছনে ফেলে সে স্থান দখলে নিয়েছে চীন। চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ২০০০ সালে ছিল মাত্র ৯০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২১ সাল নাগাদ এটি ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হওয়ার কথা রয়েছে। চীন বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। আর বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। বাংলাদেশের পাট জাতীয় পণ্যও চীনের বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চীন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সর্বাধুনিক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এছাড়াও দেশটি যুক্ত আছে বাংলাদেশের জনগণের ‘স্বপ্নের সেতু’ পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের সঙ্গে। এর বাইরে পরিবহন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও টেলিযোগাযোগসহ নানা ক্ষেত্রে চীনের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের নির্মাণ কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।