ফেসবুক একটি বিরক্তিকর ভাল লাগা- তপতী দাস
জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ আগস্ট ২০২০, ৪:১০ অপরাহ্ণআধুনিক প্রযুক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে বিস্ময়কর আবিষ্কার জোকারবার্গের ফেসবুক।এটি আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের মত।সার্চ দিলেই সামনে এসে দাঁড়ায়-হুকুম করুন মালিক।কে জানতো এটি এতো জনপ্রিয় হবে ? মার্ক জোকারবার্গ নিজেও হয়তো ভাবেননি। আজ যদি ঘোষণা দেয়া হয় যে, আগামী মাস হতে ফেসবুক বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সব আগের অবস্থায় ফিরে যাবে, তাহলে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে ? আমার তো মনে হয় হঠাৎ অক্সিজেন বন্ধ করে দেবার ঘোষণার মতো হবে। আপামর জনসাধারণ বিশেষ করে যুব সমাজ রাস্তায় নেমে শ্লোগান শুরু করবে “চলবে না, চলবে না”।
আমরা অভিভাবকগণ ছেলে-মেয়েদেরকে কত শাসিয়েছি। বিজ্ঞের ন্যায় উপদেশ দিয়েছি, এটা কখনো ধরবে না।এটার জন্য লেখাপড়া নষ্ট হয়, এটা বাজে জিনিষ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোবাইল নিষিদ্ধ হবার কারণে ছেলেমেয়েদের কত যে মোবাইল ধ্বংস করা হলো তার খবর পত্রিকান্তরে বহু দেখেছি। সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন ঢুকে গেলো ছাত্রছাত্রীদের মোবাইলে। এখন ক্লাস হচ্ছে মোবাইলে, টিচার বলে দিলেন আমার এ লেখাটি আমার ওয়েবসাইটে দেয়া আছে, দেখে নিও- ছাত্ররা তখন বাধ্য মোবাইল দেখতে।
ফেসবুক একটি সামাজিক নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইট যা বন্ধু,পরিবার ও ব্যবসায়িক সহযোগীদের সংযুক্ত করে। এর একটি জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে ছবি, অডিও, ভিডিও সংযুক্ত, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা যায়। এতে দেশের খবর, দশের খবর, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, বিভিন্ন অপরাধ জনিত খবর ইত্যাদি সবই পাওয়া যায়-যা আমরা গণ মাধ্যমে কিঞ্চিত পরেই পাই।সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত অনেক খবরকে সরকারও গুরুত্ব দিয়ে থাকেন,তদন্তও হয় দ্রুত।যতদুর মনে হয় পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষই এখন ফেসবুক ব্যবহার করে থাকেন। এটি একটি সোশ্যাল মিডিয়া। করোনাকালীন দূর্যোগে আমরা সবাই যখন গৃহবন্দী ছিলাম তখন যদি ফেসবুক না থাকতো তাহলে সময় কাটানোটা খুবই দূর্বিষহ হয়ে উঠতো। তাছাড়া আমাদের বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়স্বজন,সহকর্মী কে কখন, কিভাবে আছেন, করোনা পজিটিভ কি না,সুস্থ হচ্ছেন কিনা তা সবই ফেসবুকের কল্যাণেই প্রতি মুহুর্তে পাচ্ছি।এখান থেকে বিস্তর জ্ঞানার্জনও করা যায়। এমন অনেক বন্ধু, আত্মীয় বা সুহৃদজন আছেন দীর্ঘদিন যাদের কোন যোগ সূত্র ছিল না, তাদের সাথেও এই ফেসবুকের কল্যাণে আবারও বন্ধন তৈরী হয়েছে,কথা হয়েছে,ছবি আদান-প্রদান, ভিডিও কলে কথা বলা হয়েছে। শুভ দিনে শুভেচ্ছা বিনিময় ও দুর্দিনে দুঃখ প্রকাশের সুযোগ হয়েছে।আরো একটি সুবিধা হলো ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা যায় কিন্তু কোন মাশুল দিতে হয়না।আপনার চাপায় যতক্ষণ কুলোয় চালিয়ে যান।
ফেসবুকের যেমনি ভালো দিক আছে, তেমনি কিছুটা খারাপ দিকও আছে। এটি এমনই একটি নেশা যে, অধিকাংশ জনগণ আমরা এত বেশী নিমগ্ন হয়ে যাই এই ছোট্ট একটা মুঠোফোনের মোহনীয় যাদুতে। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে, মোবাইলের নেশা আর আফিমের নেশায় নাকি পার্থক্য নেই। আমরা মোবাইলের কারনে গতানুগতিক কত কাজই না বিনষ্ট করি।কত মহিলার যে ভাত নষ্ট হয়, তরকারী কড়াইতে দিবার মনে না থাকায় চূলায় আগুন ধরে, দুধ পুড়ে অঙ্গার, কত সমস্যা বলে শেষ করা যায় না। পুরুষদেরও যে নেই তা বলা যাবে না। স্ত্রী বাজার যেতে বলে গেল, স্বামী মোবাইলে কি লোড দিয়ে সেটা দেখতে উদগ্রীব হয়ে গেলো। স্ত্রী এসে জিজ্ঞেস করলো দোকান থেকে যে লবন আনতে বলে গেলাম এক ঘন্টা আগে, এনেছ নাকি? স্বামীর উত্তর, বলেছিলে নাকি ? আমরা ঘুম থেকে উঠেই দেখতে চাই কে, কি পোস্ট করলো? কোন পোস্টে কত রিয়েক্ট ও কমেন্ট এলো? এতে ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব বাড়ে-সামাজিক বন্ধুত্ব কমে যায়। পরিবারের সাথে সময় কাটানো হয় কম।এটা মাঝে মাঝে আমাদের মনে ঈর্ষার কারণও হতে পারে। যেমন কেউ দামী আইফোন, গাড়ী বা বাইক বা কত দামী শাড়ি কিনলেন- সে সব পোস্ট দিলে মনে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, মনোকষ্টের কারণও হয় কারো কারো।
ফেসবুক আমাদের আবার সুরক্ষাও নষ্ট করে দেয়। আইডি হ্যাক করে নানা ধরনের স্ক্যান্ডাল বা মিথ্যা খবর বা ছবি দিয়ে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত দেয়া সহ অনেক অনর্থ ঘটায়। ভার্চুয়াল জগতের মানুষ আর রক্তমাংসের মানুষ কখনোই এক হয়না। প্রতিদিন আমরা ফেসবুক ব্যবহার করছি। এখন বিশেষজ্ঞ গণের ভাবার সময় যে, এটা আমাদের জীবনকে নষ্ট করে দিচ্ছে নাকি বেশী উপকারই করছে।
ফেসবুকে আমার, আপনার সবারই অনেক অনেক বন্ধু আছেন। আমরা তাদেরকে নিয়ে গর্ববোধ করি। কতবড় উচ্চ পদের একজন কর্মকর্তা,তিনি আমার ফেসবুক বন্ধু। কিন্তু কিছু কিছু উচ্চ পদের ফেসবুক বন্ধু আছেন- যাঁরা কোনদিন কোন কমেন্ট, লাইক বা কোন ধরনেরই সাড়া দেন না, তখন আবার মনটা খুব আহত হয়। তবে হ্যাঁ তাঁদের ব্যস্ততা, চিন্তা চেতনা অনেক ব্যাপক নিঃসন্দেহে।পরে আবার উনারা অবসর জীবনে গেলে বেশীরভাগই খোঁজখবর নিতে ভুল করেন না।
ফেসবুকের বন্ধুদের মধ্যে কিছু আছেন সক্রিয়, আর কিছু বন্ধু নিষ্ক্রিয়।নিষ্ক্রিয় মানে তাঁরা কোন পোস্টেই সাড়া দেননা। রিয়েক্ট, কমেন্ট কিছুই করেন না। তাঁরা একটু আভিজাত্য নিয়ে চলতে চান। তাঁরা ভাবেন, মন চাইলে সাড়া দেবো নইলে দেব না এমন। আমি চেষ্টা করি আমার ফ্রেন্ডলিস্টের প্রায় সবার পোস্টেই সাড়া দিতে। যারা কোনদিনও আমার পোস্টে সাড়া দেন না,তাদের পোস্টেও আমি সাড়া দেই। মনে হয় এটা আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা নয় কিছুটা দায়িত্বও বটে। নইলে তো আনফ্রেন্ড করে রাখাই শ্রেয়। যাঁরা নিজেরা রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ফ্রেন্ড হয়েছেন, তাঁদের প্রতি ধন্যবাদ/ কৃতজ্ঞতা/অভিনন্দন প্রকাশ করাও একটা ভদ্রতা-এতে নিজের মহত্বই প্রকাশ পায়।
আমি ফেসবুকে আসি ২০১৭ এর ডিসেম্বরে। এইটুকু সময়ের অভিজ্ঞতার আলোকেই বিশ্লেষণটি, হয়তো কিছু অসম্পূর্ণ, কিছু অপ্রয়োজনীয় হতে পারে। কাউকে ছোট করে বলছি না, প্রসঙ্গক্রমে একটি বাস্তব বিষয় আজ লিখতে চাই, আমার এক ক্লাসমেটকে আমি বারবার রিকোয়েস্ট পাঠালে সে একসেপ্ট করলো ঠিকই কিন্তু পরক্ষণেই ইনবক্সে লিখছে আমি কেন তাঁকে বিরক্ত করছি। আমি ৫ মিনিট ভাবলাম, সে ভাগ্যগুণে আজ প্রশাসনের উঁচু পদে আসীন তাঁকে বিরক্ত করার অধিকার আমার নেই।আমি তখনই তাঁকে আনফ্রেন্ড করে দিলাম।তবে আমি রিকোয়েস্ট পেলে ভেবে দেখে অবশ্যই একসেপ্ট করি।আমি চেষ্টা করি অধস্তন অস্থায়ী কর্মচারী, আনসার, পিয়ন, সিকিউরিটি গার্ডদের পোস্টে সাড়া দিতে।তাদেরকে খুশী করতে আমার কোন ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয়না – এতে আমার কখনোই মনে হয়না যে আমার সম্মান হানি ঘটছে। আমার ফ্রেন্ডলিস্টের বেশিরভাগ বন্ধুই আমাকে প্রচুর স্নেহ করেন,ভালোবাসেন,কেউ কেউ শ্রদ্ধাও করেন। আমি তাঁদের কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।
আমি শুধু আমার কথাই বলছিনা, লক্ষ্য করেছি অনেকের প্রোফাইলেই একটা পোস্টে ফ্রেন্ডলিস্টের এক চতুর্থাংশেরও কম লোকের সাড়া মিলে। কিছু বন্ধু আছেন অকারণেই ইনবক্সে টুনটুন করে বিরক্তিকর কিছু প্রশ্ন করেন যেমনঃ আপনার বাড়ি কোথায়,এখন কি করছেন, আপনি কি করেন, আপনি কি খেয়েছেন,কি দিয়ে খেয়েছেন, নাস্তা কি হয়েছে, আপনার একটা ছবি দিবেন কি, আপনার ফোন নম্বরটা কি দেয়া যাবে, আপনার পরিবারে কে কে আছেন,কখন ঘুমাবেন, আপনার পাশে কে আছেন? যদিও এগুলোর মাঝে প্রয়োজনীয় অধিকাংশই প্রোফাইলে দেয়া থাকে। আমি মনে করি অহেতুক এ প্রশ্নগুলো করে উভয়েরই মূল্যবান সময়টা নষ্ট করলেন। আমি মনে করি নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণকে রিকোয়েস্ট পাঠানো বা একসেপ্ট করা থেকে বিরত থাকাই ভালো।
যেমনঃ (১) যাঁরা ভূঁয়া নাম ব্যবহার করছেন(২) যাঁরা ছদ্মনামধারী বা বিকৃত নামধারী(৩) যাঁরা প্রোফাইলে নিজের ছবি না রেখে অন্যকিছুর ছবি যেমন জীবজন্তু, পাখি ইত্যাদির ছবি রেখেছেন।
(৪) যাঁরা জন্মতারিখ সঠিকভাবে উল্লেখ করেননি (৫) যাঁরা অহেতুক ম্যাসেঞ্জারে বিরক্ত করেন (৬) যাঁদের ওয়ালে আপত্তিকর লেখা,অডিও, ভিডিয়ো ক্লিপ বা নোংরা ছবি আছে। প্রসঙ্গত আরো একটি বিষয় নিয়ে লিখতে হচ্ছে সেটা হলো WI-FI নেটওয়ার্ক।আমরা যারা এ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছি, তাঁরা এ সীমাহীন নেটওয়ার্কের কারণেই ফেসবুকে নিমগ্ন থাকি বেশিরভাগ সময়।আগে মোবাইল নেটওয়ার্ক ছিলো, এটা ছিলো লিমিটেড, মনে হতো আমার MB, GB শেষ হয়ে যাচ্ছে আর বেশি সময় ফেসবুকে থাকা যাবেনা। আসলে ওটাই ভালো ছিলো।তবে আমি মনে করি WI-FI থাকলেও আমরা যদি নিজেরা লিমিটেড হয়ে যাই তাহলে এ সমস্যা সমাধান হবে। তবে পারছিনা তো,আমি নিজেই পারছিনা।আপনারা চেষ্টা করে দেখতে পারেন।আমি নিজেই এখন হাসছি,উপদেশ দেয়াটা কতো সহজ! WI-FI এর প্রভাবে আমাদের ছেলেমেয়েরা যেনো নষ্ট হয়ে যায়না সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। ফেসবুকে নতুন আর একটি সংযোজন হচ্ছে বিয়ে।দেশ আর বিদেশের বালাই নেই,জড়িয়ে পড়ছে প্রেমে।এখানে অভিভাবক থাকেন অন্ধকারে, তাই দু’চারজন বিদেশি বধূও আমরা পেয়েছি ইতোমধ্যে।পেলেও কি হবে প্রতারণার সংবাদই আছে বেশি যেমন ছবির সাথে মিল নেই, বয়সের অমিল, গায়ের বর্ণ আশানুরূপ নয়,সে কল্পিত রাজকন্যাও নয় অথবা পেশায় সে আদৌ বড়ো ব্যবসায়ী বা বড়ো কর্মকর্তা নয়।আরো আরো কত যে বিড়ম্বনা,পরে ভুলের জগতে হা হুতাশ করে সর্বস্বান্ত হওয়া। ফেসবুকে আরো একটা যন্ত্রণার ব্যাপার হচ্ছে গ্রুপে আমন্ত্রণ জানানো।বিভিন্ন প্রয়োজনে গ্রুপ তৈরি করা লাগতে পারে।এটাকে আমি সরাসরি অপছন্দ করছিনা,তবে কেউ যদি ইনভাইট একসেপ্ট না করে তবে তাঁকে বার-বার ইনভাইট না দেয়াই উত্তম।কিছু লোক আছেন প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে গ্রুপ তৈরি করে বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানান। একজন মানুষ নিজের বন্ধু ও পছন্দের গ্রুপ ছেড়ে দিয়ে নতুন নতুন গ্রুপে সময় দেয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় কি আর তার আছে?এখন একটা সত্যি কথা লিখছি একজন বন্ধু ৩০ মিঃ আগে রিকোয়েস্ট পাঠালে আমি একসেপ্ট করলাম, সাথে সাথেই গ্রুপে ইনভাইট।এটা কার ভালো লাগে বলুন,আমি বাধ্য হয়ে তাঁকে আনফ্রেন্ড করে দিলাম। এটা এখন অনেকটা ফ্যাশন না প্যাঁচাল বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা। পরিশেষে এটাই বলতে চাই যে, ফেসবুকে আমরা একজন অন্যজনের পাঠক/পাঠিকা বা বন্ধু/বান্ধবী।এতে আমাদের মন্তব্য, প্রতিমন্তব্য থাকবে তবে ওগুলোর ভাষা যেনো শালীন হয়। আরো একটি কথা আজকাল অনেকেই প্রোফাইল লক করে রাখেন- সমস্যা নেই, আপনার কর্মস্থল বা পেশা উল্লেখ করুন যাতে অন্যজন আপনাকে সম্যক জানতে পারেন। স্রষ্টা আমাদের সুস্থ ও সুন্দর রাখুন এটাই কামনা।আমার সকল ফেসবুক বন্ধুদের শুভকামনা ও ধন্যবাদ জানাই।
লেখক: তপতী দাস,
ম্যানাজার, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড।