বিদ্যুৎহীন ৩৫ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা – ফাইজা রাফা
জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ নভেম্বর ২০২০, ২:৪৩ অপরাহ্ণ১৭ নভেম্বর ২০২০, প্রতিদিনের মতো আজ সকালেও সিলেটের মানুষ তখন নানান কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত ৷ সবাই যার যার মতো করে ছুটে চলছেন , কাজ করছেন , কেউ হয়তো তখন টেরও পায়নি সিলেটের সামনে কত বড় বিপর্যয় নেমে আসতে চলেছে ৷ ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল দশটা ৷ হঠাৎ করে সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হঠাৎ করে আগুন ধরে যায়৷ দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে ৷ আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিস ছুটে যায় ৷ ফায়ার সার্ভিস এবং দমকল বাহিনীর আপ্রাণ চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় ৷ কিন্তু কিন্তু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আগুন লাগার কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো সিলেট বিভাগে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ৷
চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে খবর ৷ সিলেট কুমারগাঁও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আগুন লেগেছে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল করতে কিছুটা সময় লাগবে৷ দিন পেরিয়ে রাত হল বিদ্যুৎ আসেনি ৷ কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগের কর্তৃপক্ষ আপ্রাণ চেষ্টা করছেন বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল করার জন্য কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ টা যে এত বড় ছিল দুদিনের মধ্যে সরবরাহ সচল করাটা অনেকটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে ৷ যাইহোক তারা তাদের আপ্রাণ চেষ্টা করে ১৮ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬ টা নাগাদ সিলেটে আংশিক কিছু জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল করতে তারা সম্ভব হন ৷ ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল হতে থাকে ৷ কিন্তু ১৭ নভেম্বর রাত ছিল এক অন্যরকম রাত ৷
সন্ধ্যার পর থেকে চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ৷ কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না ৷ যাদের জেনারেটর এর ব্যাকআপ ছিল ঐ জায়গাগুলোতে কিছুটা আলো দেখা যাচ্ছিল ৷ তা ছাড়া পুরো সিলেট শহর জুড়ে ছিল অন্ধকার ৷ ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই ইত্যাদি বেড়ে যাবার শঙ্কা করা হয়েছিল কিন্তু সিলেটের পুলিশ অনেকটাই সজাগ ছিল এ ব্যাপারে। অন্ধকারকে নিবারন করার জন্য অনেকে অনেক ভাবে চেষ্টা করছিলেন ৷ কেউ মোমবাতি দিয়ে , কেউ হারিকেন জ্বালিয়ে , কেউ টর্চ লাইট ব্যবহার করে ৷ কিন্তু বিপত্তিটা ঘটে তখনই ৷ এই বিপদের দিনেও কিছু কিছু জায়গাতে দেখা গেছে মোমবাতি নিয়ে একটা ব্যবসা চলছে ৫ টাকার মোমবাতি ২০ টাকা ৩০ টাকা এভাবে করে বিক্রি হচ্ছিল ৷ একপর্যায়ে মোটামুটি অনেকগুলো দোকান থেকেই মোমবাতি প্রায় শেষ হয়ে যায় ৷ পানির জন্য যখন অনেকেই হাহাকার করছিলেন তখন অনেকেই নামেন পানির ব্যবসা ৷
মোবাইলের চার্জ যখন মানুষের ফুরিয়ে যাবার পথে তখন অনেকেই চার্জের ব্যবসা নিয়ে বসেন ৷ জেনারেটরের ভাড়াও তখন দ্বিগুণ হয়ে যায় । এই সময়টাতে যখন মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা , সাহায্য সহযোগিতা করার কথা , সেটা যদি নাও পারে একে-অন্যের যখন মানসিক ভাবে পাশে থাকার কথা, তখন কিছু কিছু মানুষের ব্যবহার ছিল অত্যধিক খারাপ পর্যায়ে । কিছু কিছু ব্যবসায়ী নিজেদের লাভের স্বার্থের জন্য মোমবাতি, পানি ,মোবাইল চার্জ , ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস এর দাম বাড়িয়ে দেন ।
এই দুর্যোগের দিনেও নিজেদের স্বার্থ হাসিল, অতিরিক্ত মুনাফা এবং লাভের আশা নিয়ে মেতেছিলেন । নৈতিক মূল্যবোধ / মানবিক মূল্যবোধ আজ কোন পর্যায় ? অপর পাশে যখন বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল করার জন্য ৪০০ কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন ৷ সে সময় কিছু মানুষ বলে বসেন “আমরা কি বিদ্যুতের বিল দেইনা ? সারারাত ধরে কারেন্ট নাই বিদ্যুৎ কি তোর বাপের ? কাজ করতে কি এতক্ষণ সময় লাগে ? আমাদেরকে শিখাও ? ” এধরনের মন্তব্য অনেকে করে বসেন ! অনেককে দেখলাম বিদ্যুতের জন্য আন্দোলন করেন ৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার দেখা গেছে মানবতার জয় ৷ অনেকে পানি দিয়ে , খাবার দিয়ে একে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন ৷ বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটনা ঘটার দুই তিন ঘন্টার মধ্যে পুরো সিলেটে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আগুন লাগেছে ৷ ঐ সময় আমাদের অনেক কিছু করনীয় ছিল ৷ সে সময় যদি সাধারন জনগন একটু সচেতন ভাবে চলতো তাহলে সেই হাহাকারটা হতো না ৷ যেমন মোবাইল ফোনের কম ব্যবহার করে , মোবাইলের ব্রাইটনেস কমিয়ে , মোবাইলের পাওয়ার বাটন অন করে , এসকল কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করে মোবাইলের চার্জ টা কিছুটা হলেও ঠেকানো সম্ভব হতো ৷পানির অপ্রয়োজনীয়’ ব্যবহার যদি বন্ধ করতেন তাহলে পানির জন্য এভাবে হাহাকার হতো না ৷
সে সময় আমি কি করেছি ? আমি যখন আগুন লাগার খবর পাই ৷ তখন পরিবার ও আমার আশেপাশের মানুষদের কে সচেতন করি ৷ যে কুমারগাঁও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আগুন লেগেছে ১/২ দিন কারেন্ট না আসার সম্ভাবনাই বেশি ৷তখন নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে মোবাইলের চার্জ পানির অপ্রয়োজনীয়’ ব্যবহার বন্ধ করি ৷ যেহেতু কিছু টা শীতের দিন যার কারণে গরম নিয়ে ভাবতে হয়নি ৷ যাইহোক ১৭ নভেম্বররের অন্ধকার রাত পার হয়৷ আমার যখন রাত্রে নিজেদের নিদ্রায় তখন ৪০০ কর্মী নিজেদের ঘুম ভুলে কাজে ব্যস্ত ৷ ১৮ নভেম্বরের দিনের শুরু ৷ বরাবরের মতো বিদ্যুৎ নেই ৷ সকলের মনে প্রশ্ন যে কবে কখন আসবে বিদ্যুৎ ? দুপুরের দিকে কিছুটা আশার বাণী শুনা যায় ৷ ১৮ নভেম্বর সন্ধ্যার দিকে কারেন্ট আসার সম্ভাবনা রয়েছে৷ সেই আশায় সকলের বুক বাধতে থাকেন সবাই ৷ বিদ্যুৎ অফিসের তথ্য অনুযায়ী সন্ধ্যার পরেই কারেন্ট আসা শুরু হয় ৷ বিদ্যুৎ বিভাগ তারা তাদের কথা রাখেন এবং সন্ধ্যার মধ্যে কিছুটা বিদ্যুৎ সচল করতে সক্ষম হন । সিলেট বিভাগ আবারও আলোকিত হতে থাকে । বিদ্যুৎ আসার পর সকলের চোখে মুখে এক আনন্দের ছাপ ছিল । শহরজুড়ে যে হাহাকার ছিল তা অনেকটাই কেটে যায় । সকলেই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন । কেউবা মোবাইল চার্জ দিতে কেউ বা পানি তুলতে । বিদ্যুৎ আসার পর জনজীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে ৷ সকলেই শান্তি নিঃশ্বাস ফেলেন ৷ যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এত দ্রুত বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়েছে তাদের সকলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই ৷ এত বড় দুর্ঘটনা ঘটার পর , ৩৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকার পরও আশার কথা হচ্ছে , এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি ৷ তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান অনেক ৷ আগুন লাগার কারন তা তদন্ত চলছে ৷ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আমাদের সকলকে আরো দায়িত্বশীল এবং ধৈর্যশীল হতে হবে । কোন দুর্ঘটনায় ইচ্ছাকৃত বা কারো হাতে থাকে না ৷ দুর্ঘটনা ঘটলে ধৈর্য ধরাটা সবচেয়ে ভালো এবং সে সময় বুদ্ধি খাটিয়ে একটু চলাই উত্তম ।