নবীগঞ্জে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চলছে পাহাড় কাটার মহোৎসব

ছনি আহমেদ চৌধুরী
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩:০১ অপরাহ্ণ
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় দিনারপুর পরগণার বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় আবারও চলছে নির্বিচার পাহাড় কাটার মহোৎসব। প্রশাসনের বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ ও মামলার আনুষ্ঠানিকতায় প্রকৃত অপরাধীরা রয়ে যাচ্ছেন অদূরপ্রান্তে, আর ধ্বংস হচ্ছে শত বছরের টিলা–পাহাড়ের প্রাকৃতিক স্থিতি। পরিবেশবিদদের অভিযোগ, কাগুজে ব্যবস্থা গ্রহণ নয়—নিয়মিত তদারকি ও কঠোর আইনি প্রয়োগ ছাড়া পাহাড় কাটা বন্ধ করা অসম্ভব।
শুক্রবার দুপুরে উপজেলার পানিউমদা ইউনিয়নের ববান চা বাগানের ভেতরে প্রায় এক একর এলাকাজুড়ে পাহাড় কেটে সমতল করে ফেলার প্রমাণ মেলে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দিনারপুরে পাহাড় কাটার মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যায়। তাদের দাবি, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগে এলাকায় প্রভাবশালী কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রত্যক্ষ ছত্রছায়ায় দীর্ঘদিন ধরেই পাহাড় কাটা চলে আসছে। নতুন ক্ষমতার সমীকরণ তৈরি হওয়ার পর সেই দৌরাত্ম্য আরও বেপরোয়া রূপ নিয়েছে।
গত এক সপ্তাহ ধরে প্যারাগণ গ্রুপের মালিকানাধীন ববান চা বাগানের ভেতরে একটি সংঘবদ্ধ চক্র প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া রাতের আঁধারে পাহাড় কেটে বিভিন্নস্থানে মাটি বিক্রি করে আসছিলো।
শুধুমাত্র এখানেই নয়—দেবপাড়া ইউনিয়ন, গজনাইপুর ইউনিয়নের কুড়াগাঁও এবং পানিউমদার পামিউমদা, রোকনপুর, বড়চরসহ বিভিন্ন এলাকায় একই কায়দায় টিলা কেটে সমতল করছে অসাধু ব্যক্তিরা।
২০১৫ সালে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের করা রিটের প্রেক্ষিতে দিনারপুর এলাকায় পাহাড়–টিলা কাটায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করেছিলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু আদালতের সেই নির্দেশনার এক দশক পরও পাহাড় ধ্বংসের এই দৌরাত্ম্য থামেনি।
ইতিমধ্যেবপ্যারাগণ গ্রুপের মালিকানাধীন ববান চা বাগানে পাহাড় কাটার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন নবীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রত্যয় হাশেম। এঘটনায় পানিউমদা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী দাবী হয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে বাগানের স্বত্বাধিকারী মশিউর রহমান, ম্যানেজার মোস্তফা কামাল আমীর ও টিলাবাবু বিনয় চন্দ্র বর্মণকে আসামি করে নবীগঞ্জ থানায় মামলা করা হয়েছে। তবে স্থানীয়দের প্রশ্ন—পাহাড় কাটার মধ্যবর্তী সময়ে প্রশাসন কোথায় ছিল?
পানিউমদা ইউনিয়নের হরতকিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আমির হোসেন বলেন, “পাহাড় কাটার খবর দিলে প্রশাসন সঙ্গে সঙ্গে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয় না। পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি শেষ হলে এসে অভিযান চালানো হয়। স্থানীয় ভূমি অফিস সব জানলেও রহস্যজনক কারণে দ্রুত ব্যবস্থা নেয় না।”
পরিবেশ আন্দোলন বাপা হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, “অবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপ নিলে পাহাড় কাটা বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু প্রশাসনের ধীরগতি ও অসংগতির কারণেই প্রতিনিয়ত পাহাড় কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে অঞ্চলটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য।”
এ বিষয়ে নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন বলেন, “আমরা পাহাড় কাটার বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছি। দিনারপুর এলাকার পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।”
তবে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা—প্রশাসনের শিথিল নজরদারি ও তদারকি–ঘাটতির সুযোগে নবীগঞ্জে পাহাড় কাটার এই মহোৎসব থামছেই না। দিনারপুরের পাহাড়–টিলা ধ্বংসের এই বেপরোয়া চিত্র তুলে দিচ্ছে এক ভয়ংকর পরিবেশ–ঝুঁকির ইঙ্গিত। তাই পরিবেশ রক্ষায় প্রশাসনকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের দাবী স্থানীয়দের।



