চা শ্রমিকদের জীবন লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের কুড়ে ঘরে বন্দী
জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ মে ২০২০, ৩:১৯ অপরাহ্ণছনি চৌধুরী :
হবিগঞ্জ জেলায় রয়েছে ২৪ টি চা বাগান। এর মধ্যে নবীগঞ্জ উপজেলায় ইমাম-বাওয়ানী, ববান চা বাগান।
আর এসব বাগানের চা শ্রমিকেরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। চা গাছ ছেঁটে যেভাবে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেয়া হয় না। চা শ্রমিকের জীবনও যেন চা গাছের মতোই। লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের কুড়ে ঘরে বন্দী। চা বাগানের জীবনও যেনো এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। আর বাগানটাই শ্রমিকদের কাছে গোটা পৃথিবী। দিনে আট ঘণ্টা টানা কাজ করেও সকালে চা-পাতা ভাজা, দুপুরে শুকনা রুটি এবং রাতে মরিচ দিয়ে ভাত খেয়ে জীবন কাটাচ্ছেন হবিগঞ্জের চা শ্রমিকরা। টানা আট ঘণ্টার প্রচন্ড পরিশ্রম শেষে প্রতিদিন একজন শ্রমিক ২৩ কেজি চা-পাতা সংগ্রহের পরেও মজুরি হিসেবে পাচ্ছেন মাত্র ১০২ টাকা। অনেক আন্দোলনের পর চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি মাত্র ১৭ টাকা বাড়িয়ে ১০২ টাকা করা হয়েছে। তবে এ মজুরিতে সন্তুষ্ট নয় চা শ্রমিকরা।
এই টাকায় শ্রমিকরা না নিজে ভালোভাবে খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারছেন, না তাদের সন্তানরা ভালোভাবে বেড়ে উঠছে। আর পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে চা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরাও অপুষ্টিতে ভুগছেন।
পরিবেশবীদরা বলছেন, বাগান থাকলে পর্যায়ক্রমে শ্রমিকের বেতন আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট, মাধবপুর, বাহুবল, নবীগঞ্জের ১৫ হাজার ৭০৩ দশমিক ২৪ হেক্টর পাহাড়ি এলাকাখ্যাত বাগানগুলো রা হলে চা শ্রমিকদের সুদিন ফিরে আসবে। তবে শ্রমিকরা আর আশার বাণী মানতে রাজি নন।
স‚ত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ আন্দোলনের পর চা শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৬৯ টাকা থেকে বেড়ে ৮৫ টাকা এবার অনেক আন্দোলনের পর মজুরি মাত্র ১৭ টাকা বাড়িয়ে এখন ১০২ টাকা, সাপ্তাহিক ছুটির দিনের মজুরি প্রদানসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মালিকপরে সঙ্গে দ্বিপীয় চুক্তি স্বারিত হয়েছে। শ্রমিকরা অধিকার আদায়ে মাঝে মধ্যে আন্দোলনে নামতেও বাধ্য হন। তবে সকল বঞ্চনা, ঝুঁকি-অনিশ্চয়তা মেনে নিয়েই বাগান আঁকড়ে জীবন কাটান শ্রমিকরা। এমনকি বাগানে কাজের জন্য অযোগ্য বিবেচিত হলেও, এই বাগানেই কোন না কোনভাবে থেকে যাবার চেষ্টা করেন তারা। কেননা বাইরের জীবন তাদের কাছে একেবারেই অচেনা। তবে বাগান কর্তৃপক্ষ নিজেদের ভ‚মিকার কথা বেশ স্বগৌরবেই দাবী করেন। নবীগঞ্জ উপজেলার পানিউমদা ইউনিয়নে অবস্থিত ইমাম চা বাগানের ম্যানাজার ফখরুল ইসলাম বলেন- বর্তমান সরকার চা শ্রমিকদের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন। সরকার তাদের রেশন দিচ্ছেন, ভাতা দিচ্ছেন, শ্রমিকদের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌছে দিছেন, সোলার দিছেন। আগে কোন সরকার এরকম সুবিধা দেয়নি।
চা শ্রমিকদের দিনকালঃ- শ্রম মন্ত্রণালয় তিন শ্রেণির চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৬৯, ৬৭ ও ৬৬ টাকা নির্ধারণ করেছে। আগে তাদের মজুরি ছিল যথাক্রমে ৬২, ৬০, ৫৯, ৮৫ টাকার পর ১৭ টাকা বেড়ে এখন ১০২ টাকা। সঙ্গে সপ্তাহে ৩ কেজি রেশনের চাল ও আটা। এ দিয়ে পরিবার নিয়ে তিন বেলা খাবার জোটে না শ্রমিকদের। সকালে লবণ দিয়ে এক মগ চা আর সাথে দুমুঠো চাল ভাজা খেয়ে বাগানে যেতে হয়। অথচ বাগান মালিকের জমি সরকারেরই খাস জমি। সামান্য অর্থে লিজ নিয়ে বাগান করে বেসরকারি কোম্পানিগুলো। ‘অল্প টাকা মজুরি পাই। এতে একজনেরই চলে না। ছেলে মেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে গেছে’- বলছিলেন ইমাম চা বাগানের শ্রমিক নেতা রাম ভজন। চা বাগান ঘুরে শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপকালে অনেক শ্রমিক তাদের ক্ষোভের কথা জানান।
চা শ্রমিকদের ভাষার ব্যবহার দেখলে মনে হবে এখনও বৃটিশ শাসনামল চলছে। এই যেমন- ব্যবস্তাপককে ডাকে ‘বড় বাবু’ বলে। সহকারি ব্যবস্তাপককে ‘ছোট বাবু’ বলে ডাকে। এছাড়া ব্যবস্তাপকের বাসার কাজের লোকদের ‘বেয়ারা’ বলে ডাকা হয়। এছাড়া কেউ বেড়াতে গেলে তাদেরকে ‘সাহেব’ বলে চা শ্রমিকরা।
একটু পিছনে ফেরাঃ-
এই শিল্পটি স্থাপিত হয়েছিল বৃটিশ ঊপনিবেশিক সময়েই। পাহাড়ি জায়গা বেছে নেয়া হয় চা শিল্পের জন্য। শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় সমাজের সবচেয়ে নিচু শ্রেণির হরিজন, কোল, মুন্ডা, কৈরি, চন্ডাল, সাঁওতাল প্রভৃতি স¤প্রদায়ের লোকজনদের যাদের নিজস্ব সমাজ সংস্কৃতি থাকলেও তা উক্ষেপিত। জানা গেছে, বৃটিশরা চা শ্রমিকদের মাদ্রাজ, বিহার, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ, ঝাড়খন্ডের রাত্রি, ডোমকা, নাগপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে এনেছিল। চা বাগান বানানো ছাড়া অন্য কোন কাজ জানা নেই এদের।
রক্তাক্ত ইতিহাসঃ-
বাংলাদেশে চা শিল্পের ইতিহাস ১৫০ বছরের। সিলেটে চা বাগান তৈরির শুরুর দিকে উন্নত জীবনযাপনের আশা নিয়ে জন্মমাটি ছেড়ে চা বাগানে কাজ করতে আসে দণি ও মধ্য ভারতের অভাবী মানুষ। কিন্তু কাজে এসে তাদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে যায়। স্বপ্নভঙ্গের জ্বালা নিয়ে তারা ফিরতে চায় নিজের দেশে। শ্রমিকরা দেশ ত্যাগ করতে গেলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নির্বিচারে হাজার হাজার চা শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে। ১৯২১ সালের ২০ মের সেই রক্তাক্ত পরিণতিতে চা শ্রমিকদের দেশে ফেরার স্বপ্নও শেষ হয়ে যায়।
অপ্রতুল চিকিৎসাসেবাঃ-
বাগানগুলোতে নেই কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির পরিবর্তে এখনও তারা অতিপ্রাকৃত শক্তির উপর নির্ভর চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করে। আর তাই চা বাগানের শত শত শিশু অপুষ্টির শিকার। তবে বর্তমানে চা বাগানগুলোতে হাসপাতাল থাকলেও সেখানে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ দেয়া হয়। অন্যদিকে নারী শ্রমিকরা মাতৃত্বকালীন ছুটিও ঠিক ভাবে পায় না। জানা গেছে, এমনও হয়েছে কর্মস্থলেই অনেক বাচ্চার জন্ম হয়েছে।
শিক্ষা ও বিনোদন ব্যবস্থাঃ-
সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী সকল চা বাগানে স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা রয়েছে। তবে সেটার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়নি। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, অনেক চা বাগানে শিক্ষার আলো ছড়ানোর ব্যবস্থা নেই। আর যাও আছে সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার (আইএলও) বিধান অনুযায়ী, ৮ ঘন্টা শ্রমের নিয়ম থাকলেও চা শ্রমিকদের কোন শ্রমঘন্টা নেই। আর বিনোদনের তো প্রশ্নই আসে না। চা শ্রমিকদের বিনোদন বলতে নেশায় বুদ হয়ে থাকা। তবে এখন অনেকে বিভিন্ন খেলাধুলা করে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী চা বাগানঃ-
দিনটি ঐতিহাসিক ৪ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এই দিনে হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বাংলোটিতে দেশ স্বাধীন করার জন্য ঐতিহাসিক এক শপথ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ২৭ জন সেনা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকেই সমগ্র রণাঙ্গনকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী। তেলিয়াপাড়া চা বাগান ব্যবস্থাপকের বাংলোটিকে ৩ নম্বর সেক্টরের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বৈঠক শেষে এম.এ.জি ওসমানী নিজের পিস্তলের ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের শপথ করেন। বাংলোর সামনে একটি বুলেট স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।