সড়ক-রেলপথে মহাদুর্ভোগ
![](https://jago.news/images/icon.png)
জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ জুলাই ২০২২, ৪:১০ পূর্বাহ্ণ![](https://jago.news/wp-content/uploads/2022/07/EID-Durbug.jpg)
ঢাকার আগারগাঁও থেকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরের দূরত্ব ২৮ কিলোমিটার। গতকাল শুক্রবার ভোর ৪টায় কুমিল্লার মুরাদনগরের উদ্দেশে রওনা করে এই পথ পার হতে ছয় ঘণ্টা লেগেছে তৌফিকুল ইসলামের। আট কিলোমিটার দীর্ঘ হানিফ ফ্লাইওভারে লাগে তিন ঘণ্টা। শ্যাওড়াপাড়া থেকে ৩০০ টাকা বাস ভাড়া দিয়ে তিনি সায়েদাবাদ যান।
প্রায় অভিন্ন অভিজ্ঞতা ট্রেনের যাত্রী আশিকুল ইসলামের। রায়েরবাগ থেকে ৪০০ টাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় কমলাপুর গিয়ে তিন ঘণ্টা বসে ছিলেন নীলসাগর এক্সপ্রেসের অপেক্ষায়। ৭টার নীলসাগর যখন সকাল ১০টায় ছাড়ে, তখন ট্রেনটিতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। ছাদেই অবস্থান নেন হাজারো যাত্রী। যাত্রী ছিল শৌচাগারেও। ভিড়ের চাপে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে বগির স্প্রিং বসে যাওয়ায় ট্রেনটি যমুনার বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তে আটকে ছিল প্রায় চার ঘণ্টা।
আশিকুল ও তৌফিকুলের মতো লাখ লাখ মানুষের আনন্দের ঈদযাত্রা মাটি হয়েছে যানজট, বাড়তি ভাড়া, পরিবহন সংকট ও ভিড়ের কারণে। গাবতলী টার্মিনাল থেকে আরিচাঘাটের বাস ভাড়া ১৫০ টাকা হলেও, নেওয়া হয় ৬০০ টাকা। বাস সংকটে উত্তরবঙ্গের যাত্রীরা ট্রাকে জনপ্রতি ৫০০ টাকায় বগুড়ায় গেছেন।
সাধারণ মানুষের ব্যাপক ভোগান্তি হলেও সরকারি ভাষ্যে যানজটের ভয়াবহতা নেই। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এবারের ঈদে ছুটি কম হওয়ায় একই সময় লাখ লাখ মানুষ গ্রামে যাচ্ছেন। কোরবানির পশুবাহী গাড়ি ধীরে চলায় এবং পথিমধ্যে নষ্ট হওয়ায় কোথাও স্বল্প সময়ের জন্য যানজট হচ্ছে।
যানজটে আনন্দের ঈদযাত্রা মহাদুর্ভোগের :উত্তরবঙ্গের যাত্রীরা গাবতলী থেকে যমুনার বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ভুগেছেন যানজটে। সেতুর পূর্ব প্রান্তে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দিনভর দীর্ঘ যানজট ছিল। ঢাকার মহাখালী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তার দূরত্ব ২৭ কিলোমিটার। এ পথটুকুতে লেগেছে ছয় থেকে আট ঘণ্টা।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকেই সায়েদাবাদ টার্মিনালে যেতে তিন থেকে চার ঘণ্টা ব্যয় করতে হয় যাত্রীদের। ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণবঙ্গমুখী যাত্রীদেরও। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে প্রবেশের পর পোস্তগোলা সেতু পার হয়ে ইকোরিয়া পর্যন্ত যানজট ঠেলে যেতে হয়েছে পদ্মা সেতুর যাত্রীদের।
বাগেরহাটের যাত্রী নিয়াজ আহমেদ জানান, প্রাইভেটকারে যাত্রা করে ফ্লাইওভারে উঠতে নিমতলীতে এক ঘণ্টা আটকে ছিলেন। দুই ঘণ্টায় ফ্লাইওভার পার হন। সেখান থেকে ইকোরিয়া যেতে লাগে আরও এক ঘণ্টা। বাকি পথ পদ্মা সেতু হয়ে গিয়েছেন পাঁচ ঘণ্টায়।
অভিযোগ রয়েছে, পদ্মা সেতু চালুর পর ফ্লাইওভার ও নিচের রাস্তায় চাপ বাড়বে জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মূল অংশে যানজট না থাকলেও সায়েদাবাদ থেকে মহাসড়কের মূল অংশে পৌঁছতেই মহাদুর্ভোগ হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠানের ভাষ্য, পরিবহন সংকটে মহাসড়কে লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি নেমেছে। সেগুলো বিকল হওয়ায় যানজট। বঙ্গবন্ধু সেতুতে আগের রাতে তিনটি দুর্ঘটনা হয়। সেতুর পূর্ব প্রান্তে একটি গাড়ি গতকাল দুপুরে বিকল হয়। এতেই যানজট হয়।
পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে যানজট নেই দাবি করে প্রধান প্রকৌশলী বলেন, টোলের নয়টি বুথই সচল। ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের গাজীপুর অংশেও যানজটের কারণ লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি ও পশুবাহী গাড়ি। সড়ক ভাঙাচোরা নেই।
টাঙ্গাইলের ট্রাফিক পরিদর্শক এরশাজুল হক জানান, চার লেনের মহাসড়কে ৬০-৭০ কিলোমিটার গতিতে চলা গাড়ি এলেঙ্গায় দুই লেনের সড়কে আটকে যাচ্ছে। এতে করে এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার পথে যানজট হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানার ওসি শফিকুল ইসলাম জানান, সেতুতে বাস-পিকআপের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। এতে এক ঘণ্টা ৪০ মিনিট টোল আদায় বন্ধ রাখা হয়। ফলে যানজট হয়।
ঢাকা-উত্তরবঙ্গ ও ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর অংশে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কলকারখানা ছুটির পর থেকেই যানজট। উত্তরের মহাসড়কের জয়দেবপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা অংশে ভোগড়া থেকে চন্দ্রা মোড় হয়ে করোটিয়া পর্যন্ত যানজট ছিল।
টাঙ্গাইলের সফিপুরে আলমগীর হোসেন নামের একজন যাত্রী জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা করেন। ১৭ ঘণ্টা লেগেছে সফিপুর আসতে।
মতিন সরকার নামের অপর যাত্রী বলেন, বাস না পেয়ে রাত ১১টায় পিকআপে ঢাকার গাবতলী থেকে রওনা করে ১২ ঘণ্টায় সফিপুর এসেছেন।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মাওনা পর্যন্ত ছিল যানজট। বাস না থাকায় গতকাল টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সড়কে হাজারো মানুষকে গাড়ির অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে। ট্রাক, পিকআপের মতো পণ্যবাহী গাড়ির পিছু ছুটেছেন তাঁরা।
বাসের অপেক্ষায় দিন পার: মনিরুজ্জামান নামের একজন যাত্রী জানান, গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে যাবেন তিনি। শুক্রবার রাত ১২টায় তাঁর বাস ছাড়ার কথা ছিল। ন্যাশনাল ট্রাভেলস এসএমএসে জানিয়েছে, ১০ ঘণ্টা দেরিতে অর্থাৎ শনিবার সকাল ১০টায় ছাড়বে বাসটি। গাবতলী, কল্যাণপুরের সব পরিবহনের বাসেই বিলম্ব হচ্ছে।
হানিফ পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন জানান, যানজটের কারণে বিভিন্ন জেলা থেকে বাস ফিরতে পারছে না ঢাকায়। এ কারণে ঢাকা থেকে ছাড়তেও দেরি হচ্ছে।
অথচ গত রোজার ঈদেও যাত্রীর অপেক্ষায় ছিল বাস। কিন্তু গতকাল গাবতলী, কল্যাণপুর, মহাখালী, সায়েদাবাদে দেখা যায়- লাখো মানুষ অপেক্ষায় রয়েছেন; কিন্তু বাসে সিট নেই। একটি টিকিটের জন্য যাত্রীরা কাউন্টার থেকে কাউন্টারে ছুটছেন। অধিকাংশ পরিবহনের কাউন্টার বন্ধ।
বাসে ইচ্ছা মতো ভাড়া: নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে গাবতলীতে রংপুরের বাসের অপেক্ষায় থাকা আরিফ ও তাঁর তিন বন্ধু বলেন, গ্রামীণ ট্রাভেলস ও রেখা পরিবহনে রংপুরের ভাড়া ১ হাজার ৭০০ টাকা করে চাইলেও নিয়মিত ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় যাতায়াত করেন তাঁরা। ওই তিন বন্ধু বলেন, তাঁরা তিনজনই গার্মেন্ট শ্রমিক। এই টাকায় তাঁদের বাড়ি যাওয়া কষ্টসাধ্য। অপেক্ষা করছেন হাজার টাকার মধ্যে বাস পেলে যাবেন।
আগাম টিকিট বিক্রি হলেও বেশ কিছু কাউন্টারকে দেখা গেছে দ্বিগুণেরও বেশি দামে তাৎক্ষণিক টিকিট বিক্রি করতে। প্রশাসনের চোখ এড়াতে ৫০০ টাকার ভাড়া ১ হাজার টাকা লিখে রাখা হয়েছে। যাত্রীর কাছ থেকে টাকা বুঝে পাওয়ার পর টাকার অঙ্কের ওপর কাটাকাটি করা হয়েছে।
হানিফ পরিবহনের গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের টিকিট কাউন্টারের দায়িত্ব পালন করা মো. রনি বলেন, খালি মানুষ আর মানুষ। গত কয়েক বছরে গাবতলী-কল্যাণপুর এলাকায় এত যাত্রী দেখা যায়নি।
মহাখালী টার্মিনালে দেখা যায়, সৌখিন, রাজীব, মা-মণি, রনিসহ বিভিন্ন পরিবহন ডেকে ডেকে বাসে যাত্রী তুলছে। ময়মনসিংহের সর্বনিম্ন ভাড়া ৬০০ এবং জামালপুর, শেরপুরের ভাড়া হাজার টাকা। অথচ ময়মনসিংহের সরকার নির্ধারিত ভাড়া ২৭০ টাকা। সৌখিন পরিবহনের কর্মী বললেন, ঈদের কয়েক দিনই তো তাঁরা বাড়তি নেন। সারা বছর কম রাখেন।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মোটরসাইকেল বন্ধের সুযোগে বাসে ভাড়া ডাকাতি চলছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে ঢাকার অভ্যন্তরীণ রুটে ভাড়া ডাকাতি শুরু হয়েছে। উত্তরা থেকে সায়েদাবাদের ভাড়া ৫০ টাকা হলেও নেওয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা। শ্যামলী থেকে গুলিস্তানের ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ২০০ টাকা। ধানমন্ডির সায়েন্সল্যাব থেকে সদরঘাটের ভাড়া ২৫ টাকা হলেও ২০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
ট্রেনে শিডিউল বিপর্যয়, কর্তৃপক্ষ নির্বিকার :রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস সাড়ে তিন ঘণ্টা বিলম্বে গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় কমলাপুর স্টেশন থেকে ছাড়ে। চিলাহাটির নীলসাগর এক্সপ্রেস তিন ঘণ্টা ২০ মিনিট বিলম্বে সকাল ১০টায় ছাড়ে। খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস চার ঘণ্টা দেরিতে দুপুর ১২টায় যাত্রা করে। এভাবে রেলের পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় সবক’টি ট্রেন বিলম্বে ছেড়েছে। রংপুর বিভাগের আট জেলা ও বগুড়ার ট্রেনগুলোয় তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। একই অবস্থা ছিল ময়মনসিংহ, জামালপুর ও মোহনগঞ্জগামী ট্রেনের। দুপুর সোয়া ২টায় যাত্রা করা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের ছাদে, ইঞ্জিনে, দরজায় ঝুলে থাকতে দেখা যায় যাত্রীদের।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১১টায় ঢাকার কমলাপুর থেকে যাত্রা করে সকাল সাড়ে ৮টায় পঞ্চগড়ে পৌঁছানোর কথা পঞ্চগড় এক্সপ্রেসের। কিন্তু চার ঘণ্টা দেরিতে যাত্রা করা ট্রেনটি সকাল পৌনে ৬টায় বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব স্টেশনে পৌঁছে। হাজারো যাত্রী ছিলেন ট্রেনটির ছাদে। ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইনকা কোম্পানির কাছ থেকে তিন বছর আগে কেনা পঞ্চগড় এক্সপ্রেস বিকল হয়। ট্রেনের পাঁচটি বগির চাকার স্প্রিং বসে যায়। প্রায় ছয় ঘণ্টা যমুনার পূর্ব প্রান্তে আটকে ছিল ট্রেনটি।
সুন্দরবন এক্সপ্রেসের অপেক্ষায় থাকা যাত্রী সোহেলী বেগম কমলাপুরের প্ল্যাটফর্মে সন্তানদের বাতাস করছিলেন খবরের কাগজ মুড়িয়ে। তিনি বলেন, সারারাত লাইন দিয়ে টিকিট কিনেছেন। এখন আবার ট্রেন আসার অপেক্ষার যন্ত্রণা। আর সহ্য হয় না।
স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারোয়ার বলেন, ৬০-৭০ হাজারের বেশি যাত্রী এসেছেন দুপুর ১২টা পর্যন্ত। তাঁদের আটকাতে পারেনি পুলিশ ও রেলপুলিশ। যাত্রীরা জোর করে টিকিট ছাড়াই ট্রেনের বগি ও ছাদে উঠে গেছে। এ কারণেই বিলম্ব ও ভোগান্তি।
![](https://jago.news/wp-content/uploads/2024/02/WEB.png)