‘সুমন, আমি ডা. সাবরিনা বলছি, তুমি খুব কিউট…’
জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জুলাই ২০২০, ৩:১৭ অপরাহ্ণকরোনার নমুনা পরীক্ষায় প্রতারণা মামলায় জেকেজি’র চেয়ারম্যান, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল থেকে বহিষ্কৃত ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে একের পর এক তথ্য। প্রতারণার জন্য তিনি নিতেন নানা ছলচাতুরির আশ্রয়।
সরকারের কাছ থেকে বিনা মূল্যে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে বুকিং বিডি ও হেলথকেয়ার নামে দুটি সাইটের মাধ্যমে টাকা নেওয়া এবং নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া সনদ জালিয়াতি করার অভিযোগে গ্রেপ্তার জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ও জাতীয় হৃদেরাগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা চৌধুরীর মোবাইল ফোন চেক করে অনেক মেসেজ পেয়েছে পুলিশ। প্রতিটি মেসেজের শুরুতেই সাবরিনা নিজেকে জেকেজির চেয়ারম্যান দাবি করেন বলে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদকারী ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন।
তদন্তে পাওয়া একটি ম্যাসেজে, সাবরিনা লিখেছেন, ‘সুমন আমি জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা বলছি। তুমি খুব কিউট। আমার প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি। করোনা নমুনা সংগ্রহ করতে সব ধরনের সহযোগিতা কর।’
এ প্রসঙ্গে তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়েছে। তিনি কিভাবে প্রতারণার ফাঁদ পেতে করোনা নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া সনদ দিতেন সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।
জানা গেছে, ডা. সাবরিনাকে সোমবার (১৩ জুলাই) সকালে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে চার দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম শাহিনুর রহমান তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) সকালে ডিবি কার্যালয়ে এনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, সাবরিনার মোবাইল ফোন চেক করে সাতটি মেসেজ পাওয়া গেছে। প্রতিটি মেসেজে সাবরিনা বিভিন্ন মানুষকে কখনো জেকেজির চেয়ারম্যান, কখনো সমন্বয়ক আবার কখনো আহ্বায়ক পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করেছেন। তাকে সহযোগিতাকারী অনেক প্রভাবশালীর নাম জানা গেছে।
তেজগাঁও থানা সূত্র আরো জানিয়েছে, জেকেজির বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রতারণার এবং আরেকটি থানায় হামলা, ভাঙচুর ও পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে করা হয়েছে। প্রথম মামলাটি দায়ের করেন কামাল হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী। সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ, করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া প্রতিবেদন দেওয়া ও জীবন বিপন্নকারী রোগের সংক্রমণের মধ্যে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনা হয় এজাহারে। ওই মামলায় গত ২৩ জুন আরিফুলকে গ্রেপ্তারের পর জেকেজি কর্মীরা তেজগাঁও থানায় গিয়ে বিক্ষোভ করে। পরে পুলিশ বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করে এবং তাতে জেকেজির ১৮ কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আরিফের গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে দুজন ব্যবসায়ী একই থানায় আরো দুটি মামলা করেন। এর একটিতে ১২টি ল্যাপটপ ভাড়া নেওয়ার নামে আত্মসাৎ করা এবং অন্যটিতে দুটি আর্চওয়ে এবং ২০টি ওয়াকিটকি কিনে টাকা না দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে আরিফকে তিনটি প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
আর সাবরিনাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে প্রথম মামলায়। পুলিশ জানিয়েছে, তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রতারণার বাকি দুই মামলায়ও তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
এর আগে রাজধানীর কল্যাণপুরের একটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়কের অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গত ২২ জুন জেকেজি হেলথকেয়ারের সাবেক গ্রাফিক্স ডিজাইনার হুমায়ন কবির হিরু ও তার স্ত্রী তানজীন পাটোয়ারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরে প্রতিষ্ঠানটির সিইও আরিফুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কে এই ডাক্তার সাবরিনা?
জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। তার স্বামীর নাম আরিফ চৌধুরী। এই দম্পতির জীবনও রূপকথার মতো। আরিফের চতুর্থ স্ত্রী সাবরিনা। আরিফের এক স্ত্রী থাকেন রাশিয়ায়, অন্য একজন লন্ডনে। আরেকজনের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তবে ছাড়াছাড়ির পরও সাবেক ওই স্ত্রী বিভিন্ন জায়গায় আরিফের জন্য দেনদরবার করে যাচ্ছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত সাবরিনার হাত ধরেই করোনার স্যাম্পল কালেকশনের কাজটি হাতিয়ে নেয় অনেকটা অখ্যাত জেকেজি নামের এই প্রতিষ্ঠান। প্রথমে তিতুমীর কলেজে মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি মিললেও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার অন্য এলাকা আর অনেক জেলা থেকেও নমুনা সংগ্রহ করছিলেন তারা। স্বামী-স্ত্রী মিলে করোনা টেস্ট করলেও তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের নয়। স্ত্রীর সঙ্গে অশালীন অবস্থায় দেখতে পেয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এক চিকিৎসককে মারধর করেন আরিফ চৌধুরী। পরে এ ঘটনায় স্বামীর বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় জিডি করেন ডা. সাবরিনা। এছাড়া জেকেজির এক কর্মীকে অশালীন প্রস্তাব দেওয়ার ঘটনায় গুলশান থানার আরিফ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। বিএমএর নেতার পরিচয় ভাঙিয়ে চলাফেরা করেন সাবরিনা।
গত ২৪ জুন জেকেজির গুলশান কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে আরিফসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। দু’জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। জেকেজির কার্যালয় থেকে ল্যাপটপসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করে পুলিশ। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় মোট চারটি মামলা দায়ের করা হয়। সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তি ছিল জেকেজির। পরে ওই চুক্তি বাতিল করা হয়।
জানা যায়, জেকেজিতে চাকরি করতেন নার্স তানজিনা পাটোয়ারী ও তার স্বামী হুমায়ূন কবির। তানজিনার বেতন ছিল ৩০ হাজার টাকা। ভুয়া করোনা পরীক্ষা করে কোটি কোটি টাকা কামানো দেখে তানজিনা দাবি করেন তার বেতন বাড়িয়ে দিতে হবে। বিষয়টি জেকেজির কর্ণধার আরিফ চৌধুরী জেনে তানজিনা ও তার স্বামীকে চাকরিচ্যুত করেন। পরে তারা দুজন বাসায় বসে নিজেরাই করোনার ভুয়া টেস্টের বাণিজ্য চালান।
তানজিনা নমুনা সংগ্রহ করতেন আর ঘরে বসে তার স্বামী রিপোর্ট তৈরি করতেন। ২৩ জুন রাতে তানজিনা ও তার স্বামী গ্রেফতার হওয়ার পর বেরিয়ে আসে জেকেজির প্রতারণার রহস্য। এর পর জেকেজির গুলশান অফিসে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় প্রতারক আরিফ চৌধুরীসহ অন্যদের। ওই দিনই প্রতিষ্ঠানটির কিছু কর্মী আরিফকে ছাড়িয়ে নিতে তেজগাঁও থানায় জড়ো হন। তারা থানার বাইরে হট্টগোল করতে থাকেন। এ ঘটনায় পৃথক একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এদিকে, রেজিস্টার্ড চিকিৎসক হয়েও ডা. সাবরিনা নিজের খেয়াল-খুশিমত হাসপাতালে আসতেন বলেই জানা গেছে। নিজেকে দেশের প্রথম নারী কার্ডিয়াক সার্জন দাবি করতেন তিনি। সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, মিথ্যাচার, অনৈতিক সুবিধা নেয়াসহ নানা অভিযোগ জেকেজি চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনার বিরুদ্ধে। যদিও এ অভিযোগের বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি ডা. সাবরিনা। তার কর্মকাণ্ডে বিব্রত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট প্রশাসন। তিন দিনের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা দেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে ডা. সাবরিনাকে। তবে তার আগেই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনাকে বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে বাংলাদেশের প্রথম নারী কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে দাবি করে আসছিলেন ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। এমনকি এ দাবির পক্ষে অনড়ও থাকেন তিনি। যদিও তার এ দাবিকে পুরোপুরি মিথ্যা বলে আখ্যা দিলেন হৃদরোগ ইনস্টিউটিউটের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান এবং তার অন্য সহকর্মীরাও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার এক সহকর্মী বলেন, কথাটা একদমই যুক্তিসঙ্গত নয়। প্রথম নারী কার্ডিয়াক হিসেবে এই ইনস্টিউটিউট থেকে পাস করেছেন শিমু পাল আপু। তিনি এখন পরিবারসহ যুক্তরাষ্ট্র থাকেন।
হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার চিকিৎসক হয়েও নিয়মিত দায়িত্ব পালন না করা, নিজের ইচ্ছেমত চলা, অনৈতিক সুবিধা নেয়া, এমনকি অধীনস্থদের সাথে দুর্ব্যবহার করাসহ অনেক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে সাবরিনার দাবি, জেকেজির সিইও আরিফ চোধুরীর সঙ্গে অনেক আগেই বিচ্ছেদ হয়েছে তার। কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, বিচ্ছেদের পরও কেন স্বামীর সাথে জেকেজির হয়ে কাজ করেছেন তিনি।
এর জবাবে সাবরিনা বলেন, ওনার সাথে আমার বনিবনা হচ্ছিলো না। গত আড়াই মাস ধরে আমি আমার বাবার বাসায় অবস্থান করছি। যদিও সাবরিনার চেম্বারে গিয়ে দেখা যায়, স্বামী আরিফের নামের সাথেই যুক্ত করেই রয়েছে তার নাম।
সাবিরনার এমন অনেক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে বিব্রত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের প্রশাসন। তিন দিনের মধ্যে এসব বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দেয়ার নির্দেশও দেয়া হয়েছে। কোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নেবে না বলেও জানিয়েছেন হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক।
এদিকে, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইনকে বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। রোববার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান স্বাক্ষরিত আদেশে তাকে বরখাস্ত করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইন চাকরিতে থেকেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেকেজি’র চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট প্রদান ও অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে আজ ১২ জুলাই পুলিশের হাতে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সরকারি কর্মকর্তা হয়ে সরকারের অনুমতি ছাড়াই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থাকা এবং অর্থ আত্মসাৎ সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইনকে সরকারি কর্মচারী বিধিমালার বিধি ১২ (১) অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। সাময়িক বরখাস্তকালীন সময়ে তিনি বিধি অনুযায়ী খোরপোষ ভাতা প্রাপ্ত হবেন। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
এর আগে ডা. সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তেজগাঁও বিভাগীয় উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) কার্যালয়ে ডাকা হয়েছিল দুপুরে। কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।