শাবি শিক্ষার্থী বুলবুল হত্যা কি পূর্বপরিকল্পিত ?
জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জুলাই ২০২২, ৯:১৮ অপরাহ্ণশাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বুলবুল আহমদ হত্যা নিয়ে নানা প্রশ্নের দেখা দিয়েছে। এই হত্যাকান্ড পরিকল্পিত কি না এমন প্রশ্নও উঠেছে। বিশেষত ঘটনার বুলবুলের সাথে থাকা ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক ছাত্রীর আচরণে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
বুলবুলকে সোমবার সন্ধ্যায় যখন ছুরিকাঘাত করা হয়, তখন তার সঙ্গে ছিলেন বাংলা বিভাগের ওই ছাত্রী। তাদের দুজনের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো বলে জানা গেছে। সোমবার রাতেই অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নগরের আখালিয়া এলাকার মাউন্ড এডোরা হাসপাতালে ভর্তি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে কাউকে কিছু না জানিয়ে মঙ্গলবার বিকেলে হাসপাতাল থেকে চলে যান তিনি। যদিও পরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাওয়া যায় তাকে।
মঙ্গলবার বিকেল ৪ টার দিকে ওই ছাত্রী কাউকে কিছু না বলে হাসপাতাল থেকে চলে জান বলে জানান শাবি প্রক্টর শরাত ইবনে ইসমাইল। তিনি বলেন, অসুস্থ অবস্থায় আমরা তাকে কাল এই হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। আজ বিকেলে সে আমাদের কিছু না বলে চলে যায়। খবর পেয়ে আমরা হাসপাতালে এসে সিসিটিভি ফুটেজে দেখতে পাই সে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেছে।
মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের পরিচালক শামীম আহমেদ বলেন, ‘অসুস্থ ছাত্রীর সঙ্গে তার একাধিক সহপাঠী ছিলেন। তার নজরদারিতে হাসপাতালে ছিল পুলিশও। তবে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বিকেল চারটার দিকে তিনি আমাদের কিছু না বলে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান।’
বাংলা বিভাগের ওই ছাত্রীকে মঙ্গলবার সকালেই হাসপাতালে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হুদা খান বলেন, ‘কালকের ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ওই ছাত্রী। সকালে আমরা তাকে হাসপাতালে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তার কথাবার্তা সন্দেহজনক মনে হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, তিনি কিছু লুকোচ্ছেন। তবে অসুস্থ থাকায় তাকে বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি।’
বিশ্ববিদ্যালয় ফটক থেকে সোমবার বুলবুলকে হাসপাতালে নিয়ে যান সমাজকর্ম বিভাগের ছাত্র আবদুল্লাহ আল রোমান। তিনি বুলবুলের ঘনিষ্ঠ বড় ভাই হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত। সেই সুবাদে তার সঙ্গে ওই মেয়েটির কথাবার্তা হতো।
রোমান বলেন, ‘ওই মেয়ে আর বুলবুলের সম্পর্ক ছিল। সোমবার বিকেলে তারা ক্যাম্পাসের গাজিকালুর টিলায় যায়। সেখানে সাতটা ৩০ মিনিটের দিকে ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে। এরপর ৭টা ৩৮ এ ওই মেয়ে আমাকে ম্যাসেঞ্জারে নক দেয়। আমি তাতে রেসপন্স না করায় ৭টা ৫১ সে আমার মোবাইলে কল দিয়ে জানায়, বুলবুলকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে।’
রোমান বলেন, ‘আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে ছিলাম। বুলবুলকে অ্যাম্বুলেন্সে করে আমি হাসপাতালে নিয়ে যাই। এ সময় ওই ছাত্রীকে হাসপাতালে যেতে বললে সে রাজি হয়নি।
তিনি বলেন, এ সময় আমি ওই মেয়েকে কিছু প্রশ্ন করি। তখন তার কথা আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়। ওই মেয়ে বলে- এক মিনিটে বুলবুলকে কয়েকজন খুন করে চলে গেছে। খুনিরা ছিতাইকারী।’
পূর্ব পরিকল্পনা না থাকলে এক মিনিটে কাউকে কীভাবে খুন করা সম্ভব সেই প্রশ্ন তুলে নোমান বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ পরান হলের ২১৮ নম্বর কক্ষে আগে থাকতাম। রাজনীতি করি তাই এখনও মাঝেমাঝে এসে এখানে থাকি। এই কক্ষেই বলবুল থাকে। সেই সুবাদে তার সঙ্গে সখ্য। পরিকল্পিতভাবেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।’
গাজীকালুর টিলা থেকে বুলবুলকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে আসা শিক্ষার্থীদের দলে ছিলেন ইশফাকুর রহমান ফাহিম। তিনি বলেন, ‘আমি তখন ওই টিলায় উঠছিলাম। এ সময় এক মেয়ের চিৎকার শুনতে পাই। এরপর আমিসহ আরও কয়েকজন এগিয়ে গিয়ে বুলবুলকে উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে আসি।’
উদ্ধারকারী আরেক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘উদ্ধারের সময় বুলবুল প্রায় অজ্ঞান ছিল। তার হাত, পা ও উরুতে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। তবে ওই তরুণী তখন অক্ষত ছিলেন। পরে শুনি তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’
বিকেলে হাসপাতাল থেকে চলে আসার পর সন্ধ্যায় ওই ছাত্রীকে ক্যাম্পাসে পাওয়া গেছে জানিয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার (দক্ষিণ) আজবাহার আলী শেখ বলেন, ‘সে এখন ক্যাম্পাসে আছে। প্রক্টরদের কক্ষে তাদের জিম্মায় রয়েছে। ভয়ে সে হাসপাতাল থেকে চলে এসেছে বলে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে।’
বুলবুলকে হত্যায় ছিনতাইকারীদের সম্পৃক্ততার কথা আসছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি এখনও পরিষ্কার হয়নি। তবে আমরা নিহত শিক্ষার্থীর মোবাইলটি খুঁজছি।’
এদিকে, বুলবুল আহমদ খুনের ঘটনায় সন্দেহভাজন তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। আর তদন্ত কমিটি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সোমবার রাতে ও মঙ্গলবার সকালে তিন জনকে আটক করা হয় জানিয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) বিএম আশরাফ উল্লাহ তাহের বলেন, আটককৃতরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকার বাসিন্দা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে এখনও কিছু পাওয়া যায়নি।
এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় সোমবার মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন বাদি হয়ে জালালাবাদ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
মামলা দায়েরের তথ্য নিশ্চিত করে জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হুদা খান বলেন, মামলায় অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে।
এদিকে, বুলবুল হত্যার প্রতিবাদে মঙ্গলবার ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছেন শাবি শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ থেকে বুলবুল হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ ৪ দফা দাবিতে ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন তারা।
এর আগে সোমবার মধ্যরাতে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে ছাত্রলীগ। রাত সাড়ে ১২ টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের সামনে প্রায় আধঘন্টা সড়ক অবরোধ করে রাখে তারা। পরে উপাচার্যের আশ্বাসে অবরোধ প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীরা।
এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রাতেই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভকারীরা ক্যাম্পাসের ভিতরেই এমন ঘটনায় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশাসনের ভুমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে এমন ঘটনা কোনভাবেই কাম্য নয়। আমরা ঘটনাটি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিব। আমি শোকসংতপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা ও তাদের ধৈর্য্য ধারনের আহ্বান জানাই।
সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে গাজিকালুর টিলায় বুলবুল আহমেদএর রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখে অন্য শিক্ষার্থীরা শাবি প্রশাসনকে খবর দেন।
পরে আহত অবস্থায় বুলবুলকে উদ্ধার করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করলে কর্তব্যরত চিকিতসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বুলবুলের বাড়ি নরসিংদী জেলায়। তিনি শাবি’র লোকপ্রশাসন বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী।
খুনিদের চিহ্নিত করা যায়নি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আবু হেনা পহিল বলেন, পুলিশ এ ঘটনার তদন্ত করছে। আশা করছি দ্রুত সময়ে খুনিরা গ্রেপ্তার হবে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আহত অবস্থায় বুলবুলকে উদ্ধার করে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে আনা হয়। কিন্তু তার রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় তাকে ওসমানী হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানের চিকিতসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।