Logo

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী

সেলিম আউয়াল
জাগো নিউজ : বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ১৯, ২০২০

image_pdfimage_print

সিলেটের রাজনীতিতে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব দেওয়ান ফরিদ গাজী। তার পরিচিতি কর্মেক্ষ শুধুমাত্র সিলেটের সীমিত পরিসরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি ছিলেন একজন জাতীয় নেতা। জাতীয় সংসদে একাধিকবার নির্বাচিত সদস্য, একবার প্রতিমন্ত্রী, আরেকবার মন্ত্রী, মৃত্যুর দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য এবং জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। এতো সব পরিচয় ছাপিয়ে তার মূল যে পরিচয় তিনি ছিলেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের ৪-৫ নং সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা। তিনি করিমগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের উত্তর-পূর্ব জোনের এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ১৮-জন এমপি, এমএলএ ডাউকীতে বসে সবাই একমত হয়ে ’তাকে মুক্তিযুদ্ধের নর্থ ইষ্ট জোনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষে ও শরণার্থী শিবিরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে গেছেন তিনি। যেখানেই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সেখানেই উপস্থিত হয়েছেন দেওয়ান ফরিদ গাজী। ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত এলাকা হিসেবে সিলেট প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, ঢাকায় জেনারেল নিয়াজী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন এবং আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন।এদিকে সিলেটের পাক বাহিনীর পক্ষ থেকে লেঃ কর্নেল সরফরাজ খান আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মসমর্পণ করেন এবং আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, সকাল ১১ টায় সিলেটের জেলা প্রশাসকের অফিস প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন সিলেটের কৃতী সন্তান আপোসহীন সংগ্রামী নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান ফরিদ গাজী। জাতীয় পতাকা উত্তোলনকালে জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান দেখাবার জন্যে সামনের সারিতে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে দাঁড়িয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার ওয়াাটকে, ব্রিগেডিয়ার কুইন, কর্নেল বাগচী,কর্নেল জানুয়েলসহ ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচুঁ পদের অফিসাররা। বাংলাদেশের মেজর জিয়া (শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান), মীর সিআর দত্ত, লেঃ কর্নেল মীর শওকত আলী, সকল এমএনএ,মরহুম ডাঃ এম এ মালিক এমপিসহ আরো এমপি এবং আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।

দেওয়ান ফরিদ গাজী প্রধান পরিচয় রাজনীতিবিদ। একই সাথে তিনি ছিলেন সাহিত্য-সংস্কৃতির কর্মী-নেতা ও সংগঠক। কখনো কখনো তার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রায় সমান্তরালে চলে আসে। সব রাজনীতিবিদের হাতে কলম থাকে না। কিন্তু দেওয়ান ফরিদ গাজীর হাতে ছিল কলম। আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনে সাপ্তাহিক যুগভেরী ছিলো উর্দ্দুর পক্ষে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা বাংলা বিরোধিতার কারণে ভাষা আন্দোলনের জোয়ারে পত্রিকাটি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ ধরনের একটি অবস্থায় ১৯৫৩/৫৪ সালে দেওয়ান ফরিদ গাজী সাপ্তাহিক সাপ্তাহিক যুগভেরীর সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। তারপর অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ নিষ্ঠার বিনিময়ে রাজনীতিক সম্পদিত যুগভেরী জনতার মুখপাত্রে পরিণত হয়। রাজনীতিবিদ-সাংবাদিক আব্দুল মতিন চৌধুরীর ইন্তেকালের পর যুগভেরী পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। দেওয়ান আব্দুল বাসিত চৌধুরীর ব্যবস্থাপনায় আবার যুগভেরী বের হতে শুরু করে। এসময় তরুণ সাংবাদিক দেওয়ান ফরিদ গাজীকে সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হল। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সহিত সাপ্তাহিক যুগভেরীর পাশাপাশি ইংলিশ পত্রিকা ইস্টার্ণ হেরাল্ড-এর সম্পাদকের দায়িত্ব ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত পালন করেন। একজন রাজনীতিবিদ হওয়া সত্বেও দেওয়ান ফরিদ গাজী ১৯৯৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশের অন্যতম প্রাচীন সাহিত্য প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দেওয়ান ফরিদ গাজী সাহিত্য সংসদে প্রচুর সময় দিয়েছেন। মাসিক সভাসহ অনেক ছোটখাটো সভাতেও নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন । মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি খুব অসুস্থ । একা একা চেয়ার থেকেও উঠতে পারেন না। কারো সাহায্য লাগে ! যখন তাকে চেয়ার থেকে তুলতে হলেও ধরে ধরে তুলতে হতো,সেই অবস্থাও তিনি সাহিত্য সংসদের বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় এসেছেন। সেটা ছিল সাহিত্য সংসদে তার জীবনের শেষ সভা। সাহিত্য সংসদের সময় দেয়াকে তিনি আরো দশজন রাজনীতিবিদের মত সময়ের অপচয় মনে করতেন না। আবার এখানে তিনি প্রচলিত রাজনীতির ধ্যান-ধারণা থেকে উর্ধ্বে অবস্থান করতেন। কবি রাগিব হোসেন চৌধুরী যখন সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক তখন ফরিদ গাজী ছিলেন সভাপতি। রাগিব হোসেন স্মৃতিচারণ করেছেন অনেক জটিলতার মুখোমুখি হয়েছি। সভাপতি দেওয়ান ফরিদ গাজীর কাছে গিয়েছি সমাধান এসেছে অতি নীরবে শান্ত মননে চমৎকারীত্ব নিয়ে। দেওয়ান ফরিদ গাজী ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুর পরগনার দেবপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা দেওয়ান হামিদ গাজী। হযরত শাহ জালাল (রঃ) এর সাথী ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হযরত তাজ উদ্দীন কুরেশী তাদের পূর্ব পুরুষ। দেওয়ান ফরিদ গাজী প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের পাঠশালায়। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালখা করেন মৌলভীবাজার জুনিয়র মাদ্রাসায়। কৃতী ছাত্র হিসেবে বৃত্তিও লাভ করেন। পরে সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। কয়েক বছর লেখাপড়া করার পর মাদ্রাসা শিক্ষা পরিবর্তন করে ভর্তি হন রসময় মেমোরিয়াল হাই স্কুল। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে কৃতীত্বের সাথে মেট্রিক পাশ করেন । ভর্তি হন সিলেট এমসি কলেজে। দেওয়ান ফরিদ গাজী ১৯৪২ সালে যখন স্কুলের ছাত্র তখনই কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলনের মাধ্যমে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। তারপর ১৯৪৫ সালে মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ডাকে আসামে বাঙ্গাল খেদাও অভিযানের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে যোগ দেন । তিনি আসাম মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সহ সাধারণ সম্পাদক ও সিলেট এমসি কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বিভিন্ন আন্দোলনে ভূমিকা পালন করেন। দেশকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করে করতে তিনি ১৯৪৭ সালের গণভোট আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদাযয়িক দাঙ্গার সময় তিনি বিপন্ন মানুষের জান-মাল রক্ষার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার মিশনে নিবেদিত প্রাণ কর্মী হিসেবে কাজ করেন। তিনি ছিলেন দাঙ্গাবিরোধী কমিটির অন্যতম সদস্য। এসময় সিলেটের বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষক সংকট দেখা দেয় । তখন দেওয়ান ফরিদ গাজী কিছুদিন সিলেট গর্ভণমেন্ট হাই স্কুল এবং রসময় মেমোরিয়াল হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৬৬-৬৮ সালের ৬ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেওয়ান ফরিদ গাজী ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন এবং একজন সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। ১৯৬৮-৬৯ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি আন্দোলন, ৬৯র গণ অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ৯০এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং ৯৪ সালের সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠার দাবীতে গড়ে উঠা আন্দোলন সবকটিতেই দেওয়ান ফরিদ গাজী পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট জেলা মুসলিম লীগের শাখা গঠিত হলে মরহুম নুরুর রহমান চৌধুরীকে সভাপতি এবং আব্দুল বারী ধলাবারীকে সাধারণ সম্পাদক করে কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন করা হয়। দেওয়ান ফরিদ গাজী এ পরিষদের নির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪সনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন পরিচালনার জন্যে বৃহত্তর সিলেট জেলায় ১০১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। দেওয়ান ফরিদ গাজী ছিলেন সেই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক।
১৯৬৪ সালে বেসিক ডেমোক্রেসী পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘোষণা করা হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টায় সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মিস ফাতেমী জিন্নাহকে মনোনীত করা হয় । নির্বাচন পরিচালনার জন্য বৃহত্তর সিলেট জেলায় ১০১ সদস্য বিশিষ্ট যে কমিটি গঠন করা হয় দেওয়ান ফরিদ গাজী ছিলেন সেই কমিটির আহ্বায়ক।
১৯৬৬ সালের ৬দফা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ায় ফরিদ গাজীকে দীর্ঘ ১১ মাস জেলে আটকে রাখা হয়। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দেওয়ান ফরিদ গাজী সিলেট-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন বৃহত্তর সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে দেওয়ান ফরিদ গাজীকে সভাপতি ও ডাঃ দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চলকে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করেন। ১৯৭৩ সালেও ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সিলেট-১ আসন থেকে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একই বছর অনুষ্ঠিত সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দেওয়ান ফরিদ গাজীকে আবারো জেলা সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদ গাজী তার নতুন নির্বাচনী এলাকা (নবীগঞ্জ-বাহুবল) নির্বাচনী এলাকা হবিগঞ্জ-১ আসনে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। তবে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে হবিগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আবারো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হবিগঞ্জ-১ আসনে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে ফরিদ গাজী সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরে তাকে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালেও তাকে মন্ত্রিত্ব দেয়া হয়। (এ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব-ডাঃ একে আব্দুল মোমেন বলেন- ১৫ই আগস্ট ৭৫ বিকেলে দেওয়ান ফরিদ গাজীকে বঙ্গভবনে নিয়ে জোর করে অনেকটা বন্দুকের নলের মুখে মন্ত্রীগিরি গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। নতুন সরকারে দেওয়ান ফরিদ গাজী একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন যেমন-বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, তেল ও গ্যাস উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদ,পর্যটন ইত্যাদি মন্ত্রণালয়। কিন্তু এত ক্ষমতা পাওয়ার পরও মন্ত্রী সাহেব মোটেই খুশি নন। সবসময় বলতেন ‘মোমেন, আমি লিখে দিলাম ২০/২৫ বছর পর বঙ্গবন্ধু আবার ফিরে আসবেন তখন তার সত্যিকার মূল্যায়ন হবে।

(‘‘দেওয়ান ফরিদ গাজী জনদরদি জননেতা’’ ডাঃ একে আব্দুল মোমেন)। দেওয়ান ফরিদ গাজী চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য: তিনি ছিলেন সহনশীল এবং অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। পুরো জীবনটাই তার কেটেছে রাজনীতি নিয়ে। কিন্তু তিনি ছিলেন ডান-বাম সবার নেতা, জননেতা। নেতা হিসেবে দল-মত নির্বিশেষে সকলের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সবাই জানেন তিনি আওয়ামী লীগের নেতা কিন্তু অনেকে নন আওয়ামীলীগার নিজের কাজে পরম নির্ভরতায় ছুটে গেছেন দেওয়ান ফরিদ গাজীর কাছে। সবার একটি আত্মবিশ্বাস থাকত তার মধ্যে রয়েছে কল্যাণকামী মানবিক বোধ। তিনি ছিলেন সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তার। কাছে নির্ভাবনায় যাওয়া যায়। সিলেট শহরে গাজী পদবীধারী অনেকে আছেন, কিন্তু গাজী সাব বলতে ফরিদ গাজীকেই বুঝাতো। দেওয়ান ফরিদ গাজী ছিলেন একজন আদর্শ দেশ প্রেমিক। নেতা দেশপ্রেমের দু’একটা উদাহরণ না দিলেই নয়: নাম উল্লেখ করেছিলেন জনৈক ব্যক্তির নির্দেশে মিত্রবাহিনীর পোষা সৈন্যরা বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালায়। তিনি তাদের এহেন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে বলেন। অতঃপর এক পর্যায়ে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। ইতিপূর্বে বর্ণিত ব্রীজ গুলো – ( সিলেটের ক্বীন ব্রীজ, সাড়ি ব্রীজ,হরিপুর ব্রীজ) কোথাও কাঠ দিয়ে কোথাও প্লান্ট দিয়ে অস্থায়ীভাবে মেরামত করা হয়েছে। মেজর জেনারেল কে বি রাও ভারতের বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব ও জেনারেলদের নামে পুনঃনির্মিত ব্রীজগুলোর নামকরণ করার জন্য একটি চিঠি ফরিদ গাজীর নামে পাঠান। রাত ১০ টায় এ বিষয়কে কেন্দ্র করে আমার সাথে তার কথোপকথন হয় আমি বিষয়টিকে সমর্থন জানাতে পারিনি কেননা আমার কাছে তা অনভিপ্রেত ও কাম্য ছিল না। তিনি আমাকে চিঠির বিষয়টি গোপন রাখতে বলেন । এবং চিঠিটি আমার কাছে দিলেন । নামকরণের বিষয়টি এখানেই শেষ হয়ে গেল এমন দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তি তিনি, (দেওয়ান ফরিদ গাজী, ‘স্মৃতি অম্লান’ আনোয়ার আহমদ)। দেওয়ান ফরিদ গাজী বিয়ে করেন মরমী কবি হাসন রাজার পুত্র কবি দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরী প্রথমা স্ত্রীর মেয়ের দিকের নাতনি গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি আব্দুজ জহির চৌধুরীর কন্যা আলম রওশন চৌধুরীকে। দেওয়ান ফরিদ গাজী ৮ সন্তানের জনক।

তার সন্তানেরা হচ্ছেন: দেওয়ান ফরিদ গাজী ৮ সন্তানের জনক। তার সন্তানেরা হচ্ছেন: আমাতুজ জহুরা লায়লা জেবিন (শামীমা), গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ (মিলাদ গাজী), গাজী মোহাম্মদ জাফর সাদেক (কয়েস গাজী), গাজী মোহাম্মদ জাবের, আমাতুজ জহুরা রওশন জেবিন (রুবা), গাজী মোহাম্মদ আশফাক নাহেদ, গাজী মোহাম্মদ জাহেদ (মৃতু-১৯৮৬), গাজী মোহাম্মদ শাহেদ (শাহেদ গাজী)। দেওয়ান ফরিদ গাজীর সহধর্মিনী আলম নুর রওশন চৌধুরী ১৯৯৫ সালের ৩ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। দেওয়ান ফরিদ গাজী যুগভেরী পত্রিকাতে সাংবাদিকতা করতেন, লেখালেখিও করতেন। তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লেখা হচ্ছে ‘‘সিলেটকে বিভাগে পরিণত করার দাবিতে কিছু লেখা এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ’’। দেওয়ান ফরিদ গাজী ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর ভোর ৫টা ৪০মিনিটে ঢাকা স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ১৯ নভেম্বর বাদ জু’মা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বিকাল ৪ টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় নামাজে জানাজা। জানাজায় জাতীয় সংসদের স্পিকার এডভোকেট আবদুল হামিদসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, জাতীয় সংসদ সদস্যরা অংশ নেন। ২০ নভেম্বর বাদ আসর সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে সর্বশেষ জানাজা ও রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন শেষে দেওয়ান ফরিদ গাজীর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী হযরত শাহজালাল (রঃ) দরগাহ সংলগ্ন কবরস্থানে তার স্ত্রী রওশন আলম চৌধুরীর কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয় । এর আগে বেলা দুইটার দিকে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার লাশ আনা হলে সিলেটের সর্বস্তরের জনতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক দেওয়ান ফরিদ গাজীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। একইদিন সকাল ৮টায় হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলা কমপ্লেক্স, সকাল ১০টায় তার জন্মস্থান নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া গ্রামস্থ ফুটবল মাঠে, বেলা ১১ টায় নবীগঞ্জ জে কে স্কুল মাঠে, বেলা সাড়ে ১১ টায় মৌলভীবাজারের শেরপুর গোল চত্বরে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন মসজিদের ইমাম মাওলানা আসাদ উদ্দিন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

অন্যান্য সংবাদ
Theme Created By ThemesDealer.Com
x
error: কপি করা নিষেধ !
x
error: কপি করা নিষেধ !