মালয়েশিয়ায় কর্মীযাত্রা : ২৫ এজেন্সি চক্রের চক্করে মন্ত্রণালয়
জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জুলাই ২০২২, ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণমালয়েশিয়ার মন্ত্রী-আমলা-ব্যবসায়ীদের আশীর্বাদপুষ্ট দেশের ২৫ এজেন্সির চক্র। তারাই পেতে যাচ্ছে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর কাজ। একটির মালিক এক মন্ত্রীর স্ত্রী, তিনটির স্বত্বাধিকারী তিন সংসদ সদস্য (এমপি)। বাকি কয়েকটির কর্ণধারও প্রভাবশালী। তাই তাঁদের বশে আনা যাচ্ছে না, মানছে না নিয়ম। অনিয়ম রুখতে ব্যর্থ হয়ে সেই চক্রের চক্করে পড়েছে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়।
মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক কর্মীরা যেন কাউকে টাকা না দেন- প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এমন সতর্কবার্তা জারি করলেও থেমে নেই লেনদেন। বাংলাদেশ সরকার এখনও মেডিকেল সেন্টারের অনুমোদন দেয়নি। তারপরও নিয়ম ভেঙে প্রতি কর্মীর কাছ থেকে সাত হাজার টাকা করে নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজ চালাচ্ছে সিন্ডিকেটের অন্তত চারটি এজেন্সি।
তবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিষয়ে তারা কিছুই জানে না। এমনকি সিন্ডিকেটের এক এজেন্সির আয়োজনে মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সির ঢাকায় এসে নিয়োগ সাক্ষাৎকারের বিষয়টিও জানা ছিল না মন্ত্রণালয়ের।
সিন্ডিকেটের কিছু এজেন্সি কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা দুমছে চালিয়ে গেলেও সরকারের তরফ থেকে মেডিকেল সেন্টারের অনুমোদন না হওয়ায় বিনা খরচে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর অনুমতি পাওয়া এজেন্সিটি সেই পথে নেই। তারা সরকারের ডাটাবেজে নিবন্ধিত কর্মীর ভিসার আবদেনও করতে পারছে না।
সব খরচ নিয়োগকারীর- কর্মী সংকটে ভুগতে থাকা মালয়েশিয়া থেকে এমন চাহিদাপত্র এলেও মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ অংশে খরচ নির্ধারণ করেছে ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। এ টাকা দিতে হবে কর্মীকেই।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রণালয়ের নির্ধারণ করা ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা খরচের মধ্যে ৫০ হাজার টাকাই এজেন্সির সার্ভিস চার্জ। যদিও মালয়েশিয়া থেকে বিনা খরচে কর্মী নিয়োগের যে চাহিদাপত্র এসেছে, তাতে নিয়োগকারী কর্মীর নূ্যনতম বেতন, অর্থাৎ দেড় হাজার রিঙ্গিতের সমপরিমাণ ৩১ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ দেবে এজেন্সিকে। মন্ত্রণালয় এজেন্সিকে বাড়তি টাকা নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ অংশের খরচে কর্মীর পোশাক-পরিচ্ছদ বাবদ ৫ হাজার ৩৫০ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। অর্থাৎ এজেন্সি বিদেশযাত্রার আগে কর্মীকে নতুন জামাকাপড় কিনে দেবে! এ টাকাও যাবে এজেন্সির পকেটে।
মন্ত্রণালয় ও জনশক্তি ব্যবসায়ীদের সূত্র জানিয়েছে, সিন্ডিকেটের মূল শক্তি মালয়েশিয়ায়। দেশটির কয়েকজন মন্ত্রী, আমলা ও জনশক্তি ব্যবসায়ী চক্র দুর্নীতির অভিযোগে বাতিল হওয়া পদ্ধতিতেই ফের কর্মী নিতে অনড়। বাংলাদেশে থাকা তাঁদের সহযোগীরাও বেশ শক্তিশালী।
দুই দেশে ক্ষমতার প্রভাবে অনুমোদনের আগেই মালয়েশিয়ার বিদেশি কর্মী নিয়োগের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির (এফডব্লিউসিএমএস) সফটওয়্যার প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি) এরই মধ্যে স্থাপন (ইনস্টল) করা হয়েছে। ফলে ২৫ এজেন্সির বাইরে কেউ কর্মী পাঠাতে পারবে না। যদিও মন্ত্রণালয় বলছে, এর বাইরেও কেউ মালয়েশিয়া সরকারের অনুমোদিত এবং বাংলাদেশ হাইকমিশনের সত্যায়িত কর্মী পাঠানোর চাহিদাপত্র দেখাতে পারলে নিয়োগ অনুমতি দেওয়া হবে।
বাংলাদেশের পাঠানো ১ হাজার ৫২০টি রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা থেকে কীসের ভিত্তিতে ২৫ এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর কাজ দেওয়া হচ্ছে- এর ব্যাখ্যা দেয়নি মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়। মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান গত জুনে ঢাকায় এসে জানিয়েছিলেন, এজেন্সি বাছাইয়ের সিদ্ধান্তে মালয়েশিয়ার মন্ত্রিসভা অনুমোদন রয়েছে। তবে ৩৪ দিনেও সেই অনুমোদনের কাগজ আসেনি।
বরং সারাভানানের বিরুদ্ধে এজেন্সি বাছাইয়ের নামে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে, সেই বেস্টিনেটের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশন (এমএসিসি)। জানতে চেয়েছে, কীসের ভিত্তিতে ২৫ এজেন্সিকে বাছাই করা হয়েছে।
মালয়েশিয়ার বিভিন্ন সংগঠনও বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের সিন্ডিকেটের বিরোধিতা করছে। তবে তাতে কিছুই থেমে নেই। জাতীয় পার্টির (জাপা) এমপি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর মালিকানাধীন রিক্রুটিং এজেন্সি ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড রাজধানীর বিজয় সরণি ‘কিউর অ্যান্ড স্মাইল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ক্লিনিকে অন্তত ১০০ কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েছে। যশোরের শার্শার শিকারপুরের ২১ বছর বয়সী রাসেল মিয়া তাঁদের একজন। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সাত হাজার টাকা দিয়েছি। ঢাকায় আসা-যাওয়ার খরচও গুনতে হয়েছে। মালয়েশিয়া যেতে কত টাকা লাগবে- তা এখনও এজেন্সি বলেনি। ‘
গত বুধবার প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেছেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা কোন কোন মেডিকেল সেন্টারে হবে, তা চূড়ান্ত হয়নি। কিছু মেডিকেল সেন্টার পরিদর্শন করা হয়েছে। আগামী ১৪ জুলাই মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা কবে থেকে শুরু হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া কীভাবে রিক্রুন্টি এজেন্সি কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাচ্ছে- এ বিষয়ে জানতে মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এমপির সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেনি সমকাল।
এদিকে প্রবাসীকল্যাণ সচিব ড. আহমেদ মুনীরুছ সালেহীন বলেন, গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর দেশটির সঙ্গে সই হওয়া সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুযায়ী, শুধু বাংলাদেশ সরকারের ডাটাবেজে নিবন্ধিত কর্মী যেতে পারবে মালয়েশিয়ায়। নিবন্ধিত কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। মেডিকেল সেন্টার অনুমোদনের আগেই যেসব এজেন্সি কর্মী সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়। সচিব বলেন, কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর খবর আমাদের জানা নেই।
তবে সমকালের হাতে আসা নথি অনুযায়ী, আরও রিক্রুটি এজেন্সি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাচ্ছে। এগুলো হলো- আবেদ এয়ার ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর, ঐচি এন্টারন্যাশনাল ও বিনিময় ইন্টারন্যাশনাল। ঐচি বনানীর গ্লোবাল মেডিকেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে, আবেদ এয়ার ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর বিজয়নগরের পারফেক্ট মেডিকেয়ারে এবং বিনিময় মতিঝিলের আল ঘোফিলি মেডিকেল সেন্টারে কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েছে। বিনিময় গত ২৮ জুন ঢাকায় মালয়েশিয়ার প্রতিনিধি এনে দেশটিতে চাকরিপ্রার্থীদের সাক্ষাৎকারও নিয়েছে। সচিব জানিয়েছেন, এ কারণে তাঁদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
আবেদ এয়ার ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর গত সোমবার ১৬ কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েছে বলে মাইগ্রেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের ওয়ার্কার অ্যাসাইনমেন্ট স্লিপের নথিতে তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির মালিক কে এম মোবারক উল্লাহ শিমুল বলেন, মাত্র কর্মীর তালিকা করা হয়েছে। তাঁর দাবি, মালয়েশিয়ার অনুমোদিত মেডিকেল সেন্টারে কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে বাধা নেই। ১২০ কর্মী পাঠানোর চাহিদাপত্রও পাওয়া গেছে।
এমন চাহিদাপত্র মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশন সত্যায়িত করেছে কিনা, তা জানতে পারেনি সমকাল। যদিও গত জুনেই বাংলাদেশ হাইকমিশন মালয়েশিয়ায় বিনা খরচে ৩২৫ কর্মী নিয়োগে সিমপ্লেক্স ইন্টারন্যাশনালের নামে তিনটি আলাদা চাহিদাপত্র সত্যায়িত করেছে।
২০ দিন পর সত্যায়িত চাহিদাপত্রের বিপরীতে নিয়োগানুমতি দিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। তবে মেডিকেল সেন্টার অনুমোদন না হওয়ায় ডাটাবেজে নিবন্ধিত কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারছে না বলে সিমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা অংশীদার আবু বক্কর এ তথ্য জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে না পারায় ভিসার জন্য আবেদনও করা যাচ্ছে না।
সিমপ্লেক্সের আনা চাহিদাপত্র অনুযায়ী মালয়েশিয়ায় যেতে একজন কর্মীকে পাসপোর্ট খরচ ছাড়া আর কোনো টাকা দিতে হবে না। বিমান ভাড়া ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা দুই দেশের বিভিন্ন সরকারি ভ্যাট-ট্যাক্সসহ সব খরচ দেবে মালয়েশিয়ার নিয়োগকারী। তবে আবেদ এয়ার ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরের মালিক মোবারক উল্লাহ শিমুল জানিয়েছেন, তিনি যে ১২০ কর্মী পাঠানোর চাহিদাপত্র পেয়েছেন, তাতে বিনা খরচে যাওয়ার সুযোগ নেই। খরচ কর্মীকে দিতে হবে।
বিএমইটির বিজ্ঞপ্তি এবং গত মাসে ঢাকায় এসে মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কর্মীর কোনো খরচ নেই। তাহলে কেন ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে- এ প্রশ্নে মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, এমওইউতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ অংশে যেসব খরচ হবে, তা কর্মী দেবে।
মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশে বলা হয়েছে, পাসপোর্ট, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, নিবন্ধন ফি, কল্যাণ ফি, বীমা, স্মার্টকার্ড, রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভিস চার্জ কর্মী দেবে। বিমান ভাড়া, মালয়েশিয়ার জামানত, বীমা, লেভি, স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ ১৫ ধরনের খরচ নিয়োগকারী বহন করবে।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, মালয়েশিয়ায় যেতে আগেরবার প্রথমে কর্মীপ্রতি ৩৭ হাজার, পরে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা খরচ নির্ধারণ করা হয়েছিল। বাস্তবে কর্মীপ্রতি চার লাখ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। এবারও তাই হতে পারে।
রিক্রুটিং এজেন্সির সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মীর সংকট চলছে। সুযোগ ছিল বিনা খরচে কর্মী পাঠানোর। শুধু সিন্ডিকেটকে আগেরবারের মতো টাকা কামানোর সুযোগ করে দিতেই বিনা খরচে কর্মী পাঠানোর সুযোগ নেওয়া যাচ্ছে না।