বাউল ক্বারী আমির উদ্দিন কেন আমরা ভুলে গেছি
জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ মে ২০২০, ১২:১৪ অপরাহ্ণআমি মুর্শিদী গানের ভাব জগতের বাউল ক্বারী আমীর উদ্দিন কে ছাত্রজীবনে প্রথম দেখি। আমি সাংবাদিক জীবনে ক্বারী আমির উদ্দিনের সাথে কয়েকটি বাউল গান অথবা পালাগানের আসর দেখেছি কাছে বসে। তার মুর্শিদী গান গুলো এতোটা মুগ্ধ তার আমি প্রায়ই ভাব জগতে ভাবি একজন সাধারণ বাউল এতো অগাদ জ্ঞানের অধিকারী কি করে হয়। বিশেষ করে তার লেখা ও সুর করা সহস্রাধিক গানের মধ্যে একটি অন্যতম গান #কেয়ামতের #আলামত #আইবো #রে #ভাই’’—গানটি বর্তমান সময়ে অনেক মিল পাওয়া যায়। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে আমরা তাকে বাংলার ঐতিহ্যবাহী গান বাউল জগতে মিস করছি।কারন তিনি বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী।অভিমানে হউক আর নিজ ইচ্ছায় হউক তিনি আমাদের মাঝে অনুপস্থিত। বাংলাদেশে তথা সিলেটের বাউল ও পালাগনের জগতে তিনি ছিলেন কিংবদন্তী। তাকে অনেকে বাউল সম্রাট বলে ডাকেন। আমি মনে করি প্রচার বিমূখ বাউল ক্বারী আমির উদ্দিন আমাদের নতূন প্রজন্মের কাছে আচার্য্যজনক একটি নাম।তার নামের সাথে জড়িয়ে বাউল ও পালাগানের অনেক কাহিনী। আমরা ছোট বেলায় ক্বারী আমির উদ্দিনের নাম শোনলে কত জায়গায় গিয়েছি এই বাউল সম্রাটকে দেখার জন্য। বাউল গানে একমাত্র শিল্পী তিনি তার গান ঠিকেট ছাড়া দেখা যেতো না।ঝাঁকড়া চুলের অধিকারী বাউল আমির উদ্দিনের আমিরী গানের একশ্রেনীর ভক্ত ছিলেন তারা সব সময় আমিরী চর্চা করতেন। তার গানের জন্য ছিলেন পাগল পাড়া।দেখতাম গ্রামের লোকজন দলবেঁধে চুটতেন কারী আমির উদ্দিনের পালাগানের অনুষ্ঠানে। কোথায় অডিও টেপ বা কলের গানে আমির উদ্দিনের গান যুবকরা দল বেঁধে বসে শোনতেন।বর্ষাকালে নদীর ধারে বা বিলের মধ্যে নৌকা নিয়ে গানের বাজনা বাঁজতো পড়ন্ত বিকালে বা রাতের আধারে। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে আমিরী গানের জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশচুম্বি। কোথায়ও আমির উদ্দিনের পালাগান শোনলে হাজার হাজার জনতা ভীড় হতো। তাই আমরা চাই ক্বারী আমির উদ্দিন কে আবারো বাংলার বাউল জগতে প্রত্যাবর্তন চাই। তিনি এবা দেশে এসেছিলেন নীরবে আবার চলে গেছেন নীরবে। কোথায়ও কোন বাউল গানের আসর করেননি। আমি আজকে লেখাটি দেবার কারন লন্ডন তার কয়েকজন ভক্ত কারী আমির উদ্দিন কে নিয়ে স্ট্যাটাস দেবার অনুরোধের প্রেক্ষিতে আজকের লেখা। আমি বিগত কয়েকদিন তার সর্ম্পকে কিছু খুঁজ খবর নিলাম এবং তার দুটি গানের বই সংগ্রহ করি। আমার কাছে মনে হয়েছে তিনি সত্যিই বাউল সম্রাট এবং বাউল শাহ আব্দুল করিমের পর তিনিই এখন একুশে পদক পাবার যোগ্য ব্যক্তি। তার প্রতিটি গানের মধ্যে রয়েছে মানব জীবনের সব রহস্যবেদ । বাউল সম্রাট ক্বারী আমির উদ্দিন তার গানের মধ্যে বর্তমান ও অতীত সর্ম্পকে বলে গেছেন। তিনি আমাদের নবীগঞ্জের সাতাইহাল মালজোড়া গানের আসরে একটি গান করে বলেছিলেন।
“““““আমানত কিয়ানত অইবে রে ওভাই. কেয়ামতের আলামত আইবো রে ভাই–। সন্তান বেহায়াপনা মা বাপরে করিবো ঘৃর্না গালাগালি মারপিট করিবো রে…
মা বাপের অবাধ্য হয়ে স্ত্রীর তাবেদার বনিবে রে….।
কেয়ামতের আলামত আইবো রে…….।
যকাত অইবো জরিমানা আপনজন হইবো বেগানা শরম ভরম উঠিয়া যাইবো রে…
গালাগালি ঝগড়া যাটি লাগিয়া থাকিবো রে….ঐ..।
যে ব্যক্তি যে কাজে যোগ্য নয় সমাজে সেই ধোকাবাজে নেতৃত্ব পাইবো রে…স্বার্থপর বেমুরদে কেলেংকার লাইবো রে..ঐ ।
হিংসা নিন্দা স্বার্থপরি ধর্ম নিয়ে মারামারি ওয়াদা করে রক্ষা না করিবো রে আলিম আলিমের শত্রু লড়াই বাধিবে রে….ঐ ।
মুরব্বি সমাজের নেতা তাদের থাকবে না যোগ্যতা তাদের কথা কেউ না শোনিবে রে সত্যবাদি মানুষ যারা তারা বিপাকে পড়িবো রে……ঐ।
এই গানিটি আমি শোনে তার ভক্ত হয়েছিলাম।
ঐ গানের আসরে তার সাথে ছিলেন আরেক বাউল সম্রাট মুজিব সরকার। এছাড়া তিনি সাতাইহাল মাঠে
ফোকগানের সম্রাট মমতাজ(বর্তমান এমপি) সাথে পালাগান করেছেন।
আজকাল দেখছি তার কেয়ামতের আলামত গানের সবটুকুই ফলে যাচ্ছে।
আমি আরেকটি গান শোনে ছিলাম মৌলভী বাজারে সাধুহাটি মালজোড়া গানের আসরে তিনি বলেছিলেন….আল্লা ছায়া মসজিদ বানাইছে….নদীর পাড়ে মসজিদ হলে ভেঙ্গে নেয় কি কারন….
এস গানের মাঝে অনেক রহস্য রয়েছে যা ভাব জগতে ভাবলে সবই পাওয়া যায়। ঐ গানের আসরে মুজিব সরকার তার কাছে কি ভাবে নাজেহাল পড়েছিলেন সেটা স্বচোখে দেখেছিলাম। পালাগানে তার খুবই বুদ্ধিদ্বীপ্ত কৌশল ছিলো। তিনি ছিলেন উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্ন বাউল সম্রাট। পালাগানে দেখেছি মমতাজ আপাকে শেষ রাতে আর ক্বারী আমিরের কাছে অঘোষিত ভাবে আত্বসর্ম্পন করতে ।নবীগঞ্জের আরেকটি আসরে দেখলাম আলম সরকার কে অসহায় হতে। তিনি ছিলেন পালাগানের রাজা। তিনি লন্ডন চলে যাবার পরে সিলেট বিভাগে এক পর্যায়ে পালাগান এখন বলতে গেলে বিলুপ্ত। আমির -মুজিব এর পালাগানে মানুষ ঠিকেট দিয়ে প্রবেশ করতেন। ক্বারী আমির উদ্দিন যে খানেই পালাগানে যেতেন সেখানেই হাজার হাজার শ্রুতা ভক্ত ঠিকেট করে পালাগান দেখতেন। এখন আর কেউ ঠিকেট দিয়ে বাউলদের পালাগান দেখে না।
জীবন্ত কিংবদন্তী সুর সম্রাট বাউল ক্বারী আমির উদ্দিন বাংলাদেশের বাউল সম্রাট বলা কোন বাড়াবাড়ি নয়। । বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ট বাউলদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ক্বারী আমির উদ্দিন সাহেবের এলাকায় বাড়ি ছিল বাউল সাধক দুরবিন শাহের বাড়ি। দুরবিন শাহের কাছে ক্বারী আমির উদ্দিন অনেক কিছু শিক্ষা নিয়েছেন। সেখান থেকেই আমির উদ্দিনের গানের প্রতি আসক্ততার শুরু বলে অনেকের অভিমত।
তিনি দুরবিন শাহের অনেক গান করেছেন। একই জেলার লোক ছিলেন বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম,রুহি ঠাকুর ও বাউল শফিকুন নুরের বাড়ি। তিনি এসব বাউলদের সাথে পালাগান করেছেন। তিনি অসংখ্য গান রচনার পাশাপাশি অনেক গানের ক্যাসেট করেছেন। তার জনপ্রিয় জারিগানের ক্যাসেট হচ্ছে কুলসুমার জারি। এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
aতার লিখা গান বেশির ভাগ বাউল শিল্পী করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাউল গানকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। তার গান নিয়ে সঙ্গীত জগতে গবেষনা হচ্ছে।
তার অনেক গান এখন চুরি হচ্ছে। কবিয়াল বাউল ক্বারী আমির উদ্দিন নিজেও জানেন না। অথবা দেশের বাহিরে থাকার কারনে অনেক কপিবাজ তার গান কপি করছেন। কিছু কণ্ঠ শিল্পী তাকে না বলে তার অনেক গান চুরি করে গেছেন অবলীলায়।
জনতার কাছে ধরা পড়েছে এটা বাউল আমিরে গান।
বাংলাদেশে সঙ্গীত জগতে প্রচার বিমূখ ক্বারী আমির উদ্দিন ইলেকট্রনিক মিডিয়া কম গান করলেও তার গান অনেকেই টিভির লাইভ শো প্রোগ্রামে গেয়েছেন শ্রুতাদের অনুরোধে । ক্বারী আমির উদ্দিন যদি টিভিতে নিয়মিত লাইভ শো করতেন তাহলে ফকির আলমগীর,ফকির শাহাবুদ্দিন,আলম সরকার, মমতাজ,শফি মন্ডল, বাউল সম্রাট কুদ্দুছ বয়াতিসহ আরো যারা এখন টিভিতে বাউল গানের আসর করেন তাদের চেয়ে জনপ্রিয় হতেন। বাউলিয়ানা গানের মর্যাদা আরো উপরে নিয়ে যেতেন। টিভিতে প্রায় দেখি বাউলরা তার গান করে খ্যাতি নিচ্ছেন। তিনি প্রবাসে বসবাসরত বাঙ্গালিদের কাছে জনপ্রিয় একজন বাউল । তিনি একমাত্র বাউল জায়গায় বসে গান রচনা করতে পারেন।
বর্তমানে দীর্ঘ দিন থেকে লন্ডনেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতেছেন এই বাউল ও গীতিকার। তিনি কেন যে দেশের প্রতি না বলা অভিমানে রয়েছেন সেটা রহস্য ভেদ করা যায়নি। গীতিকবি বাউল ক্বারী আমির উদ্দিন দেশে না থাকলেও ভুলে যাননি দেশ ও দেশের মানুষকে। এখনো তিনি অনবরত লিখে যাচ্ছেন গান।
———
{ নিচের এই অংশ টুকু ক্বারী আমির উদ্দিন সাহেবের নাতি মিজানুর রহমান আমিরী লিখা থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি }।
ক্ষণজন্মা বাউল সম্রাট জন্ম গ্রহন করেন ১৯৪৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী। পিতার নাম শাহ মুহাম্মদ রুস্তম আলী শেখ মাতা আলিফজান বিবি। তার পূর্বসুরীরা ফকিরি ধারার লোক ছিলেন তাই তার রক্তের সাথে ফকিরি টান বংশগত বলা যায়।পিতা মাতা উভয় ছিলেন সঙ্গীতনুরাগী।দশ বছর বয়স থেকেই পিতার পশ্রয় ও অনুপ্রেরনান গান গাওয়া শুরু। প্রাতিষ্টানিকভাবে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে মাদ্রাসায় ভর্তি হন তবে মন বসাতে পারেন নি। তিনি সৎপুর আলিয়া মাদ্রাসা ও সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় কিছুকাল লিখাপড়া করেন। অবশেষে ফুলতলী হতে ক্বারীয়ানা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন।সেই থেকেই নামের শুরুতে ক্বারী পদবী লাগানো।ক্বারী সাহেবের মুর্শিদ ছিলেন ফুলতলী তরিকার পীর শাহ মুহাম্মদ আনাস আলী।তাঁর মুর্শিদ তার নাম দেন ক্বারী আমির উদ্দীন। ক্বারী সাহেবের লিখায় পাওয়া যায় “ আমার জন্ম তেরশত পঞ্চাশ বাংলায় ফাল্গুন মাসের সাত তারিখ বলেন বাবা মায় “।
শৈশব থেকেই এই বাউল সাধকের বিশেষ দক্ষতা ছিলো দেশীয় বাদ্যযন্ত্র বাজানোর।
যেমন বাঁশি, কাসি, ঢোল ,একতারা, বেহালা, হারমোনিয়াম ,তবলা ইত্যাদি খুবই সুন্দরভাবে আয়ত্ব করেন।
আনুমানিক ১৯৬৩ সাল থেকেই তিনি পূর্ণভাবে সঙ্গীতের সাথে যুক্ত হয়ে যান।
তিনি নিজের লিখা ও সুর করা গানের পাশাপাশি সিলেটের অনেক মরমী কবির গান গেয়েছেন যেমন
সৈয়দ শাহনুর,রাধা রমন,হাসন রাজা,আরকুম শাহ,শীতালং শাহ,ইব্রাহীম তশনা মাওলানা ইয়াছিন ও ,দুর্বিন শাহের গান।
এখন নিজের লিখা ও সুর করা গান গেয়ে অন্যদের লিখা গান গাইতে সময় পান না।
প্রবাদে আছে “সাগর জানে না যে,তার কত জল”।
সেই রুপ উনি নিজেই বলা সম্ভব নয় উনার জীবনে কত গান গেয়েছেন কত গান রচনা করেছেন।
তিনি এই পর্যন্ত প্রায় চার হাজারের অধিক গান রচনা করেছেন।
মালজোড়া গানে ক্বারী আমির উদ্দিনের মত বিচক্ষন বাউল পূর্বেও ছিলেননা আর কখনো আসবে বলে মনে হয় না।
তাঁর জীবনে তিনি কোন মালজোড়া গানে হেরে যাননি তবে পতিপক্ষের ১২ টা বাজিয়েছেন কথার মারপ্যাঁচে। তিনি অনেক বিখ্যাত বাউলদের সাথে আসরে একসাথে গান করেছেন
বাউল কামাল উদ্দিন,বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম ,জ্ঞানের সাগর দুর্বিন শাহ,বাউল আবেদ আলী,বাউল কফিলউদ্দীন,রজ্জব দেওয়ান,আব্দুর রহমান বয়াতি সহ প্রমুখের সঙ্গে।।
আমরা এই ক্ষণজন্মা বাউল সাধকের দীর্ঘায়ু কামনা করি
লেখক – এম এ আহমদ আজাদ
সাংবাদিক – দৈনিক সমকাল