‘দেওয়ান ফরিদ গাজী আধার ঘরের বাতি’

জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ নভেম্বর ২০২০, ৫:০৭ অপরাহ্ণ
১৯৪০ সালে আমি মুসলীম ছাত্র আন্দোলনে যোগদানের পর একটি নাম ঘন ঘন শুনতাম তা ছিল, ডি,এফ,গাজী। টেকনিক্যাল অক্ষরে লেখা নামটি জানার খুব আগ্রহ মনে ছিল।
একদিন সাক্ষাত পরিচয়ে সে আগ্রহের সমাপ্তি ঘটল। ব্যক্তিটি হলেন: “দেওয়ান ফরিদ গাজী”। তৎকালীন জিলা সম্পাদক আব্দুল হকের পরেই কর্মকাণ্ডে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি। সিলেট আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন ছিল অন্যান্য জেলার চেয়ে অনেক কঠিন ও জটিল কাজ। বাংলা প্রদেশে মুসলিম লীগ অনেক আগে থেকেই দু’ভাগ হয়েছিল, এক ভাগ খাজা নাজিমুদ্দিন গ্রুপ, অন্য ভাগ শহীদ সোহরাওয়ার্দী কাম আবুল হাসেম গ্রুপ।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে নাজিম গ্রুপ গদীনশিল হল, অপর গ্রুপ বিরুদ্ধ শিবিরে অবস্থান নিল। তাই ১৯৪৯ সালে মৌলানা ভাষানী, সমছুল হক,ও শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বে ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের প্রায় সাথে সাথেই সোহরাওয়ার্দী, হাসিম গ্রুপের নেতা কর্মী সবাই একযোগে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করলেন। সিলেট ছিল আসাম প্রদেশে। পুর্ব পাকিস্তান সিলেট নবাগত। কাজেই বাংলা মুসলিম লীগের গ্রুপ এখানে ছিল না, ফলে আওয়ামী মুসলিম লীগ সেখান বাকী প্রদেশে স্বাভাবিক ভাবেই একদল নেতা কর্মী পেয়ে গেল।
সিলেট তেমনটি হয় নাই। তাই আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৫০ সালে প্রথম সফর কালে ৪/৫ জনের বেশি নেতার সহযোগিতা পাওয়া যায় নাই, ঐ সহযোগিরা হলেন: এম এ বারী, (ধলাবারী) মোহাম্মদ তারা মিয়া, নুরুর রহমান চৌধুরী, তফজ্জুল আলী, টি আম্বিয়া চৌধুরী, সৈয়দ আকমল হোসেন (কুলাউড়া) হাছন আলী (ছাতক) এবং নাসির উদ্দিন চৌধুরী, ফারুক আহমেদ চৌধুরী, মুক্তাদির চৌধুরী, এ, এস মাহমুদ, জহুরুল ইসলাম চৌধুরী, কবির আহমদ চৌধুরী প্রমুখ। কিছু ছাত্র লোক না পেয়ে সে যাত্রা ভাষানী সাহেব কমিটি গঠন না করেই খালি হাতে ফিরে যান। ১৯৫১ সালে ভাষানী সাহেব আবার সিলেট আসেন, তখনই নুরুর রহমান চৌধুরী সাহেবকে সভাপতি এবং এম,এ বারী সাহেবকে সম্পাদক করে প্রথম আওয়ামী মুসলিম লীগ সিলেট জেলা কমিটি গঠিত হল। ঐ সময়ে দেওয়ান ফরিদ গাজী ও শফিক আহমেদ পার্টিতে যোগ দেন এবং ইহাতে পার্টি শক্তি সঞ্চয় করে ।
১৯৫৪ সালে জুলুম শাহী মুসলিম লীগ সরকারের সাথে এক অসম বেলট যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বাংলাদেশের অপরাপর জিলায় যুক্তফ্রন্টের টিকেট নিয়ে যখন খন্ড যুদ্ধ চলছিল তখন সিলেটের অনেক সীটিই যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী খোঁজ পাওয়াই দুষ্কর। সিলেটে যুক্তফ্রন্ট কর্মী শিবির গঠিত হয়। কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী ও মরহুম আছদ্দর আলী। সিলেটে যুক্তফ্রন্টের ফান্ড ছিল না বললেই চলে। এমনকি কিছু সীটে প্রার্থীও ধরে বেঁধে আনতে হয়। কিন্তু গাজী সাহেব ও আছদ্দর আলীর দক্ষ পরিচালনা গুণে সিলেটে মাত্র দুটি আসন ছাড়া বাকি আসনে অপজিশন জয় লাভ করে। ১৯৫৭ সালে বাংলার বুকে এক মহা দুর্যোগ-দুর্বিপাক দেখা দিল। দেশের বৈদেশিক নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। আওয়ামীলীগ জাতীয়তাবাদী ও কৃষক-শ্রমিক পেশাজীবী মুক্তিকামীদের সমন্বিত সংগঠন ছিল। ১৯৫৭ কৃষক-শ্রমিক পেশাজীবীরা কাগমারী সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারের পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করে একটি প্রস্তাব পাস করিয়ে নেয়। ইহার প্রতিক্রীয়া হলো সুদুরপ্রসারি অল্পদিন দিনের মধ্যেই আওয়ামী লীগ ভাগ হয়ে যায়। সিলেটের আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রধান অংশ দল ত্যাগ করে নবগঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগদান করেন। প্রকৃত অর্থে পার্টি সংগঠক বলতে এক দেওয়ান ফরিদ গাজী সাহেবই আওয়ামী লীগ থেকে যান।
সেদিনকার আওয়ামী লীগের আধাঁর ঘরে এক গাজী সাহেবই বাতি জ্বেলে রাখেন। আর অতি অল্পকাল মধ্যে সিলেটে আওয়ামী লীগ গণভিত্তি লাভ করে একটি শক্তিশালী পার্টিতে পরিণত হয়। ১৯৭০ সালে নৌকার বাক্সে একচেটিয়া ভোট লাভই গাজী সাহেবের সেই কীর্তির উজ্জ্বল স্বাক্ষর। ১৯৭১ সালে বাঙ্গালী জীবন-মরণ সমস্যার স¤ুুখীন হয়। সিলেট সীমান্তে করিমগঞ্জ সিলেটের মুক্তিযুদ্ধাদের হেডকোয়ার্টারে পরিণত হয়। এই হেডকোয়ার্টারের প্রধান বা হাইকমান্ড ছিলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী। তাঁর সহযোগিতায় ছিলেন মেজর সি আর দত্ত, গাজী সাহেবের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও পরিচালনার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ না করলেই চলে না। আমাদের ন্যাপ,কমিউনিষ্টি পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা অন্যত্র ট্রেনিংয়ে যেতো না, ভিতরে ইনডাকশন ইত্যাদি বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হলেও করিমগঞ্জে সেরকম কিছুই হয় নাই। মুজিব ভাই যখন ১৯৬৬ সালে লাহোরে কনভেনশনে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন তখন এই ৬ দফার পরিণতি কী হবে? কোথাকার জল কোথায় গড়াবে? পাঞ্জাবী শাসক জমিদার-জেনারেল গোষ্ঠী যে অস্ত্রের ভাষায় ৬ দফার মোকাবেলা করবে সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু সম্যক অব্যাহিত ছিলেন। আর সেই কিয়ামত রাত্রি যখন সত্যি সত্যিই নাজিল হবে। তখন তার মোকাবিলার জন্য জিলাওয়ারী একজন করে আওয়ামী লীগ নেতা নিয়ে একটি হাইকমান্ড গঠন করেছিলেন।
এই হাইকমান্ড কিন্তু ভোটাভোটির হাইকমান্ড নয়, বকওয়াছির তর্কবাজির হাই কমান্ড নয়, এই হাইকমান্ড ছিল যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত সুশিক্ষিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা যুদ্ধ পরিচালনার, মুক্তিযুদ্ধ চলনার হাই কমান্ড। আমার জ্ঞান বিশ্বাস মতে বঙ্গবন্ধুর সেই হাইকমান্ডে দেওয়ান ফরিদ গাজী ছিলেন একজন সেনাপতি। আর আমি সততার সাথে ঐ সাক্ষ্য দিতে পারি যে, দেওয়ান ফরিদ গাজী উপর জাতির পক্ষে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার যে গুরুদায়িত্ব আরোপিত হয়েছিল, ফরিদ গাজী অত্যান্ত সাহসিকতা, যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে সে দায়িত্ব আনজাম দিয়েছিলেন, পালন করেছিলেন।
