গ্রীসে খুন হওয়া নবীগঞ্জের দুই র্যামিটেন্স যোদ্ধার লাশের অপেক্ষায় পরিবার
জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ৮:৩৬ অপরাহ্ণইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন সবসময় টানতো শাহীনকে। কিন্তু কে জানত এই স্বপ্নের দেশে গিয়ে আততায়ীর গুলিতে মরতে হবে তাকে! সমুদ্র পাড়ি, প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি। তারপরও যে যেতে হবে স্বপ্নের দেশ ইউরোপে। পূরণ করতে হবে স্বজনদের চাহিদা। এমন বিশ্বাস নিয়ে দশ বছর আগে স্থলপথে গ্রীস পাড়ি জমিয়েছিলেন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার কামড়াখাই গ্রামের আব্দুল মমিন (৪০)। চার বছর আগে একইভাবে সেখানে গিয়েছিলেন একই গ্রামের শাহীন মিয়াও (২২)।
ইউরোপের দেশ গ্রীসে দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হয়েছেন নবীগঞ্জের দুই র্যামিটেন্স যোদ্ধা। গ্রীসের রাজধানী এথেন্সের আসপোগিরগো এলাকায় এ ঘটনাটি ঘঠেছে। গত মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ১১টার দিকে গুলিবিদ্ধ মরদেহগুলো উদ্ধার করে গ্রীস পুলিশ।এই হত্যাকান্ডের খবরে নিহতের বাড়িতে চলছে স্বজনদের শোকের মাতম। ছেলের শোকে নিহতের পিতা মাতা অচেতনপ্রায়। অশ্রুসিক্ত নয়নে অপেক্ষায় আছেন কখন ছেলের লাশ বাড়ি ফিরবে।
সরেজমিনে নবীগঞ্জ উপজেলার কামড়াখাই গ্রামে গিয়ে জানা যায়, ওই গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে আব্দুল মমিন (৪০) ও একই গ্রামের নূর হোসেনের ছেলে শাহীন মিয়া (২৫) পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে দীর্ঘদিন ধরে গ্রীসে বসবাস করছিলেন। সেখানের আসপোগিরগো এলাকায় একটি কন্টেইনার কোম্পানিতে পাহাড়াদার হিসেবে কর্মরত ছিলেন আব্দুল মমিন। আব্দুল মমিন প্রায় ১৪ বছর ধরে প্রবাসে বসবাস করছেন। ইরান, তরস্ক হয়ে প্রায় ২ বছর পূর্বে গ্রীসে যান শাহীন। মমিনের সেখানে কাজে যোগ দেন শাহীনও। মঙ্গলবার রাতের কোন এক সময় দুর্বৃত্তরা একজনের মাথায় এবং অন্যজনের গলায় গুলি করে হত্যা করে। পরদিন সকালে স্থানীয়রা দুই মরদেহ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেন।
বিকেলে শাহীনের বাড়িতে দেখা গেল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ঘরের এক কোনে ছেলের ছবি হাতে বসে আছেন বাবা নূর হোসেন। বিছানায় বসে কান্না করছিলেন মা। বলছিলেন, আমার ছেলে ইউরোপে যাওয়ার জন্য পাগল ছিল। এই স্বপ্নই তার কাল হবে জানলে, যেতে দিতাম না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছেলের মরদেহটি দেশে এনে দিতে সরকারের নিকট দাবি জানাচ্ছিলেন তিনি।
একইদিন নিহত আব্দুল মমিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মারা যাওয়ার খবর শুনে ভেঙ্গে পড়েছেন স্ত্রী ও তিন সন্তান। আত্মীয়-স্বজন দেখতে এলেও কারো সাথে কথা বলতে পারছেন না তারা। ১২ বছর বয়সী সন্তান রায়হান বার বার চিৎকার দিয়ে উঠছিল, ‘ও আল্লাহ গো, তুমি আমার বাপরে আইনিয়া দেউ গো’ বলে। হাউমাউ করে কান্না করছিলেন মমিনের স্ত্রীও।
সেখানে বসবাসরত প্রবাসীরা জানান, দু’টি কন্টেইনারে ডাকাতির প্রস্তুতি নেয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় মমিন ও শাহীন বাঁধা দিলে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এনিয়ে পুলিশ তদন্তে নেমেছে এবং মরদেহগুলো বাংলাদেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলমান বলেও জানিয়েছেন।
এদিকে নিহত দুইজনের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। তাদের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তারা বাড়িতে টাকা পাঠানোর জন্য টাকা জমা করেছিল। তাদেরকে খুন করে তাদের টাকা পয়সা লুট করেছে ডাকাতদল।
নিহত আব্দুল মমিনের ২ ছেলে ১ মেয়ে। বাবা হত্যার বিচার দাবী করে তারা দেশে লাশ আনার ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
নিহত আব্দুল মমিনের মা গোলেছা বিবি কান্না জড়িত কণ্ঠে জাগো.নিউজকে বলেন – আমার ছেলেকে যারা নির্মম ভাবে হত্যা করেছে আমি এর বিচার চাই, সরকারের কাছে আমার একটাই দাবী ‘আমি আমার ছেলেরে শেষ দেখা দেখতাম চাই’ ।
নিহত আব্দুল মমিনের চাচাতো ভাই মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রফিক জাগো.নিউজকে জানান- দীর্ঘ ১৪বছর ধরে মমিন প্রবাসে বসবাস করে আসছে, সে প্রথমে ১ বছর ইরান, তুরষ্ক ২বছর ও গত ১০ বছর ধরে গ্রীসে বসবাস করে আসছে, হঠাৎ করে এমর ঘটনায় আমরা শোকে কাতর, এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবী জানাই একই সাথে নিহতদের দেশে আনতে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লীষ্টদের সহযোগীতা কামনা করছি।’
নিহত আব্দুল মমিনের ভাতিজা- মিজানুর রহমান জানান- ‘আমার চাচা দেশে থাকতে অনেক ভালো মানুষ ছিলেন, অনেক ভদ্র ছিলেন, প্রবাসে গিয়ে এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হবেন আমরা চিন্তাও করতে পারি নাই, এঘটনায় আমাদের পুরো এলাকায় শোকের ছাঁয়া নেমে এসেছে, আমরা এঘটনার সুষ্ঠ বিচারের দাবী জানাই।’
অপরদিকে নিহত শাহীন মিয়া পিতা নুর হোসেন জাগো.নিউজকে জানান– ‘অবিবাহিত শাহিন পরিবারের কথা চিন্তা করে বিগত ৭বছর পূর্বে প্রবাসে যায়, সেখানে ইরান ৪বছর, তুরষ্ক ১ বছর ও ২ বছর ধরে গ্রীস বসবাস করে আসছে, এ দুর্ঘটনার আগের আমাদের সাথে কথা হয়েছে শাহীনের এমন ঘটনায় আমরা বাকরুদ্ধ- আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই, এবং আমার ছেলেকে শেষ দেখা দেখতে চাই। লাশ দেশে ফেরাতে সরকারের সহযোগীতাও চান নিহত শাহীনের পরিবার।’
এ ব্যাপারে নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মহি উদ্দিন জাগো.নিউজকে জানান– খবরটি শুনে তিনিও শোকাহত। লাশ দেশে ফেরাতে সরকারীভাবে যা কিছু করতে হয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।
শেখ খবর পাওয়া পর্যন্ত জানা গেছে, মমিন ও শাহিনের মরদেহ গ্রীসে বাঙালি কমিউনিটি লিডারদের জিম্মায় রয়েছে। দেশে পাঠানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
ভিডিও দেখুন: